‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’- (birth control) নিয়ে লিখতে গেলে আসলে আরেকটা বই হয়ে যাবে। এর বহুদিক আছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক বহু বিষয় আছে এর সাথে জড়িত। কিছু বেসিক বিষয় আলোচনা করেই শেষ করে দিচ্ছি।পিল বলতে যা আমরা বুঝি এটা হল combined pill. মানে দুইটা নারী হরমোন ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরোন একসাথে থাকে। ১৯৬০ সালে যখন এই পিলটা বাজারে আসে, তখন ডোজ ছিল খুব হাই (১০০-২০০ মাইক্রোগ্রাম ইস্ট্রোজেন, ১০মিলিগ্রাম প্রোজেস্টেরোন) । ফলে প্রচুর সাইড-এফেক্ট এসেছে ৮০-এর দশকের গবেষণাগুলোতে। বর্তমানে যেটা বাজারে চলে সেটার ডোজ প্রায় আগেরটার ১০ ভাগের একভাগ (৩০-৩৫ মাইক্রোগ্রাম সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন, ০.৫-১মিলিগ্রাম প্রোজেস্টেরোন)। তবে এখনও এটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
তবে সমস্যা হল, পিল খাওয়াটা এখন আর শুধু ‘হেলথ-ইস্যু’ নয়। বিজয়ী সিস্টেম ‘পুঁজিবাদ’ ও তার দাসী ‘নারীবাদ’ মিলে পিল ব্যাপারটাকে একটা সামাজিক ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে। যে সামাজিক প্রিজুডিস থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের তহবিলদাতাগণ মুক্ত নন। পিল-এর বিরুদ্ধে কথা বলাটা আপনার চিন্তাগত পশ্চাদপদতার লক্ষণ হিসেবে আধুনিক (?) বিশ্বে দেখা হয়। ফলে অধিকাংশ রিসার্চ আপনি পাবেন পিল-এর পক্ষে— পিল এই-সেই উপকার করে, পিলের রিস্ক ধর্তব্যই না, ইত্যাদি।কথা ছিল ইস্ট্রোজেন প্রতি মাসে ডিম্বাণু বেরোতে বাধা দেবে, আর প্রোজেস্টেরোন জরায়ু-ভূমিকে মোটা করে দেবে, যদি ডিম্বাণু বাইচান্স এসেও পড়ে, শুক্রাণুর সাথে মিলন হয়েও যায়, জরায়ুতে ভ্রূণটা গাঁথতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেহে যে হরমোন থাকে তা মুখে খাওয়া সম্ভব না, দ্রুত ভেঙে যায়। এজন্য হরমোনগুলোর সিনথেটিক ভার্সন দেয়া থাকে পিলে— ইস্ট্রোজেনের বদলে থাকে ethinyl estradiol, আর প্রোজেস্টেরোনের বদলে থাকে progestins-দের যেকোনো একটা (৮টার যেকোনো ১টা)। ফলে ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ তো হয় ঠিক আছে, কিন্তু আরও অনেক কিছু হয় যা দেহের স্বাভাবিক হরমোনে হয় না। সুতরাং পিলকে সাধারণ হরমোন ভাবা ঠিক না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ২০১২ সালের এক স্টাডিতে এসেছে, ৮৩% আমেরিকান নারী যে পিলটা খায় তার progestin অংশটা আসে Nandrolone (19-nortestosterone) থেকে। নাম শুনে বুঝতে পারছেন? এটা পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরোনের জ্ঞাতিভাই। ফলে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে দেখুন। খবর বিবিসি’র। [2]
- পিল গ্রহণকারী নারীদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু এলাকার গঠন ‘পুরুষের মত’ হয়ে গেছে [3]
- ব্রনের সমস্যা
- মুখে লোমের আধিক্য
- নারীসুলভ বাকপটুতা কমে গেছে
- মেজাজ, আবেগ, মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতাগুলোও পুরুষের সদৃশ হয়ে গেছে।
কী? কিছু বুঝতে পারছেন? অনেকগুলো রিসার্চে একই ধরনের বিষয় উঠে এসেছে। সবগুলো একখানে পাবেন অস্ট্রিয়ার মনোবিজ্ঞানী প্রোফেসর Belinda A. Pletzer-এর এই রিভিউ আর্টিকেলে। [4] এখানে তিনি একটা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটা হল:
Nandrolone (19-nortestosterone) জিনিসটা পুরুষ এথলেটরা নেয় ‘ডোপ’ হিসেবে যাতে পুরুষালি শক্তি-ক্ষমতা বাড়ে। একে আমরা ‘ড্রাগ এবিউজ’ হিসেবে ঘৃণা করি। কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন মেয়ে তার সারা জীবন ধরে এগুলো ব্যবহার করে চলেছে। এবং সমাজ তাতে খুশি?
পিল হিসেবে বাজারে আসার আগে progestin ব্যবহার হত গর্ভপাত রোধের জন্য। আগে ৪০-৫০-৬০ এর দশকে যে progestin-টা ব্যবহার করা হত (norethindrone), সেটার পুরুষালি ইফেক্ট ছিল ব্যাপক। এমনকি পেটে মেয়ে সন্তান থাকলে সন্তানের লিঙ্গও পুরুষের দিকে এতই বেশি যেত, যে সার্জারিও করা লাগত। যদিও এখনকার progestin অতটা পুরুষালি না, বা ডোজও খুব সীমিত (drospirenone)। এরপরও নিউইয়র্কের প্রজনন হরমোনবিদ Regine Sitruk-Ware বলছেন: এগুলো এখনও পুরুষালি ভাব আনতে সক্ষম (androgenic)। সোজা কথা হল, যত সস্তা পিল, তত পুরুষালি ইফেক্ট বেশি। যত দামি, তত আধুনিক, তত এই প্রভাব কম। পুরুষ হরমোনের সাড়াদানকারী রিসেপ্টর সারা দেহে আছে। ঘাম হয় বেশি, লোম হয় শরীরে বেশি। বাংলাদেশে বা থার্ড ওয়ার্ল্ডে আমাদের মেয়েরা যেটা খায়, সেটাকে কি দামী বলা চলে? Gender stress তৈরি হচ্ছে বুঝতে পারছেন। শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েই না শুধু। দৈহিক ভাবেও নারীকে পুরুষের সমান করে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও পিলের অন্যান্য সুফল জানতে আমরা খুব সম্প্রতি কিছু রিসার্চ দেখব। আগের যুগের পিল না, বর্তমান কালের পরিশোধিত পিল নিয়েই রিসার্চগুলো:
- যারা কখনও পিল ব্যবহার করেনি, তাদের তুলনায় পিল ব্যবহারকারিণীদের স্তন-ক্যান্সারের রিস্ক ২০% বেশি। ১৮ লক্ষ নারীকে ১১ বছর ধরে ফলো করে এই রেজাল্ট এসেছে। [5] এমনকি যারা ৫ বছর খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে তাদেরও রিস্ক কমেনি। ১০ বছর যারা খেয়েছে তাদের রিস্ক প্রায় ৩৮%।
- টেস্টোস্টেরোন নারী-পুরুষ উভয়ের দেহে যৌন আগ্রহ তৈরি করে। এই পিল দেহের নিজস্ব টেস্টোস্টেরোন কমিয়ে দেয়। ফলে নারীর যৌন আগ্রহ, উত্তেজনা কেন্দ্রিক যৌনসমস্যা হয়। (Jung-Hoffman and Kuhl, 1987; Graham et al., 2007; Hietala et al., 2007)
- পুরুষালি না, এমন লেটেস্ট progestin (drospirenone) এর সুফল হল, ৪টা স্টাডিতে এসেছে, শরীরের ভিতরে রক্তজমাট বেঁধে (venous thromboembolism) যাবার রিস্ক আছে এই পিলে ৫ গুণ বেশি। [6] এই জমাট রক্ত গিয়ে নালীকে আটকে দিলেই হার্টে তাকে বলে হার্ট এটাক, ব্রেনে তাকে বলে ব্রেনস্ট্রোক। আগের আরও ১৪টা রিসার্চে পিলের সাথে রক্ত জমাটের সম্পর্কের কথা এসেছে।
- পিল ব্যবহারকারীদের ডিপ্রেশন ধরা পড়ার সম্ভাবনা ৭০% বেশি, যারা কোনোদিন ব্যবহার করেনি তাদের তুলনায়। [7] ব্যবহার শুরুর ৬ মাসের মধ্যে সম্ভাবনা বেড়ে গেছে ৪০%।
পিল ব্যবহারের উপকারিতা হিসেবে যা বলা হয়, এবং ক্ষতি হিসেবে যা বলা হয়, সব পাশাপাশি উল্লেখ করছি [8]—
<image>
আসলে পিল এখন আর শুধু ওষুধের পর্যায়ে নেই। পিল একটা জীবন-দর্শনে পরিণত হয়েছে। বর্তমান জাতিরাষ্ট্রব্যবস্থা একটা কৃত্রিম ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা একটা কৃত্রিম ব্যবস্থা। বিভিন্ন কৃত্রিম ব্যবস্থা মিলে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে— ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’। ভগবান নামে এক লোককে তার চাচা সম্পত্তির লোভে ভূত বলে সাব্যস্ত করেছিল। এখনকার অবস্থাও তা-ই। জাতীয়তাবাদী সীমানা, পুঁজিবাদের কৃত্রিম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও সবকিছুকেই ব্যবসা বানিয়ে ফেলা, ভোগবাদী মানসিকতা, স্বাধীনতার নারীবাদী ধারণা মিলে গর্ভধারণ ও জন্মদান-কেই বিভীষিকা বানিয়ে ফেলেছে। মানুষের ইতিহাসে এমন সময় কখনোই আসেনি যে, pregnancy এত ব্যাপকভাবে unwanted হয়ে গেছে। pregnancy-কে একটা রোগ মনে করা হচ্ছে, যার রিস্ক এড়াতে প্রয়োজন পড়ছে ব্যবস্থা নেবার। পিল নিয়ে শুরুর দিকের সাফাইগুলো যদি পড়েন দেখবেন, পিল খাবার রিস্ক-কে তুলনা দেয়া হচ্ছে গর্ভধারণের রিস্কের সাথে। বর্তমান কৃত্রিম বিশ্বব্যবস্থায় তথাকথিত ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ একটা বাস্তবতা। সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ থাকবে ক্যালেন্ডার মেথড (শেষে আলোচনা আছে) এবং ব্যারিয়ার মেথড (কনডম) ব্যবহার করার। পিলের শারীরিক ঝুঁকি বিবেচনায় পিল পরিত্যাগ করাই বিবেচনাবোধের পরিচায়ক। [একটা বইয়ের অংশ। কোন বই তা পরে জানানো হবে ইনশাআল্লাহ]
রেফারেন্স:
[1] K. Park, Park’s Textbook of Preventive and Social Medicine, 23rd Edition (2015), p.500.
[2] Zaria Gorvett (28th August 2018).The strange truth about the pill. BBC Future.
[3] Pletzer, Belinda et al. “Menstrual cycle and hormonal contraceptive use modulate human brain structure.” Brain research vol. 1348 (2010): 55-62.
[4] Pletzer BA and Kerschbaum HH (2014) 50 years of hormonal contraception—time to find out, what it does to our brain. Front. Neurosci. 8:256.
[5] Lina S. Morch, Ph.D. et.al.( 2017), Contemporary Hormonal Contraception and the Risk of Breast Cancer, N Engl J Med 2017; 377:2228-2239
[6] van Hylckama Vlieg, A et al. “The venous thrombotic risk of oral contraceptives, effects of oestrogen dose and progestogen type: results of the MEGA case-control study.” BMJ (Clinical research ed.) vol. 339 b2921. 13 Aug. 2009
[7] Skovlund CW, Morch LS, Kessing LV, Lidegaard O. Association of Hormonal Contraception With Depression. JAMA Psychiatry. 2016;73(11):1154–1162. [8]Oral Contraceptives: Risks and Benefits, Health Library, Winchester Hospital