‘যুদ্ধ’ শব্দটি শুনলেই যে ঋণাত্মক চিত্র আমাদের মনে ভেসে ওঠে, তার পিছনে ইতিহাসটা প্রিডোমিন্যান্টলি ইউরোপীয়।মানবেতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধগুলো ইউরোপ-আমেরিকা করেছে— দুটো বিশ্বযুদ্ধ, শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ থেকে নিয়ে বিগত ৩০ বছর জুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী অসম যুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ-কালীন আগ্রাসন (ভিয়েতনাম যুদ্ধ, রুশ আগ্রাসন ইত্যাদি)। স্রেফ প্রতিহিংসা, রাজ্যের লোভ, নারী, আন্তর্জাতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা এসবের জন্য। ইসলামের যুদ্ধের চিত্র ইউরোপের যুদ্ধের চিত্রের সাথে গুলিয়ে ফেললে আপনি বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হলেন। ঠিক যেমন ইসলামের শাসনের সাথে খৃষ্টবাদের শাসন মিলিয়ে ফেললে আপনি ইতিহাস পাঠে ব্যর্থ। ‘ধর্ম’ ক্যাটাগরিতে হিন্দুধর্ম, খৃষ্টধর্মের সাথে ইসলাম-কে রাখলে আপনি ব্যর্থ। দাসপ্রথার ইউরো-আমেরিকান ইতিহাসের সাথে ইসলামের ইতিহাসকে এক লটে ফেললে আপনি ন্যায়ানুগ বুঝ-এ ব্যর্থ। নারীর প্রতি ইউরোপীয় আচরণ আর ইসলামের আচরণ এক করে ফেললে আপনি ব্যর্থ। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের সম্পর্ক পড়তে গিয়ে যদি আপনি ইসলামকে আলাদা করতে না পারেন, আপনি ব্যর্থ। ‘মধ্যযুগীয়’ শব্দটাকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করলে আপনি ব্যর্থ। ঠিক তেমনি ‘যুদ্ধ’ শব্দটার পিছনে ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণের সাথে ইসলামের দৃষ্টান্ত ও ধারণা-কে পৃথক করতে না পারাটা নিতান্তই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ‘শিশুতোষ’।

সমস্যা হল, দার্শনিকগণ মানব-অস্তিত্ব, মানব-সমাজ, মানব-সভ্যতার ইতিহাস, উদ্দেশ্য, পরিণতি এসব নিয়ে একটা নির্দিষ্ট ‘কিছু’কে থিওরি ধরে পুরোটা ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ শুধু ‘কাম-প্রবৃত্তি’কে ধরে সবকিছুকে, আবার কেউ ‘প্রভাব-প্রতিষ্ঠাকে ধরে, কেউ ‘সর্বোচ্চ ভোগ’-কে ধরে পুরোটা ব্যাখ্যা করেছেন। কারো ব্যাখ্যা যুক্তিকে স্যাটিসফাই করে, কারওটা বুদ্ধিকে, কারও ব্যাখ্যা প্রবৃত্তিকে, আবার কারওটা ভিতরের সুকুমারবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করে। কিন্তু কেউ এমন কোনো আদর্শ ধারণা আনতে পারেননি, যা একই সাথে মানুষের বুদ্ধি-যুক্তি এবং প্রবৃত্তি ও সুকুমারবৃত্তিকে স্যাটিসফাই করতে পারে। যে ধারণাটা ইসলাম দেয়। এজন্যই ইসলাম ফিতরাতের দীন, সহজাত স্বভাবধর্ম। মানুষের বায়োলজি-সাইকোলজির সাথে যা ‘যায়’ (compatible)।

প্রাণিজগতে যুদ্ধ একটা ফিতরাতী বিষয়— আত্মরক্ষা এবং আক্রমণ, দুটোই। মাসলো-র হায়ারার্কি অব নীড-এও প্রভাব বৃদ্ধি, আত্মরক্ষা বিষয়গুলো উপরের দিকে এসেছে। এবং কী আশ্চর্যভাবে ফিতরাতের দীন ইসলাম ‘যুদ্ধ’-এর মত একটা ফিতরাতী বিষয়কে যুক্তি-বুদ্ধি-প্রবৃত্তি-সুকুমারবৃত্তি সবদিকেই পরিপূর্ণতা দিয়েছে, তা বিস্ময়কর। যা ইউরোপের যুদ্ধের চিত্র থেকে এতোটাই ভিন্ন, চোখে কীভাবে না পড়ে, সেটা আরও বিস্ময়কর।

যুদ্ধ যে ফিতরাত, এর উদাহরণ দিতে গেলে স্বতন্ত্র বই লাগবে। মানবেতিহাসে এমন কোন মোড় নেই, যা যুদ্ধ ছাড়া ঘুরেছে। এমন কোনো পট নেই যা, যুদ্ধ ছাড়া পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ যেমন এসেছে, ইহুদি জাতির ইতিহাসে ও গ্রন্থে বার বার যুদ্ধের বিধান-ইতিহাস এসেছে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট কর্মপদ্ধতি বলা আছে: শ্রমিকের রাজনৈতিক আধিপত্য, স্বৈরাচারী আক্রমণ, বিপ্লব, বিদ্রোহ। আর ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের উত্থান-লালন-আরোপ সবকিছুই যুদ্ধের মাধ্যমে। যে পুঁজিবাদের আওতার বাইরে চলে যাবার ফন্দি করবে, তার উপরেই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হবে— কখনো সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে, কখনো আরব বসন্তের নামে, কখনও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নামে। এজন্য যুদ্ধ ছিল, আছে, থাকবে।

ইসলামে ‘যুদ্ধ’ একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিভাষা, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শন ফলো করে। রিবঈ ইবনে আমের রা. যে উত্তর দিয়েছিলেন পারস্য সেনাপতি রুস্তমকে, তাতে ইসলামের যুদ্ধ-দর্শন উঠে এসেছে। সুপারপাওয়ার Persian empire-এর সেনাপতি রুস্তম জিগেস করলো মুসলিম বাহিনীর সৈন্য রিবঈ বিন আমের রা.কে: তোমরা আমাদের দেশে কেন এসেছো? ভেবেছিল, গরীব বেদুঈন এরা। অর্থসম্পদের লোভে আক্রমণ করেছে আমাদের। কিছু মালপানি খরচা করি, চলে যাক। কী দরকার খামোখা যুদ্ধ করার। রিবঈ রা. জবাব দিলেন:

  1. দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে
  2. সমস্ত বাতিল ধর্মের জুলুম থেকে দীন ইসলামের ইনসাফের দিকে
  3. মানুষকে ‘সৃষ্টির দাসত্ব থেকে স্রষ্টার দাসত্বে নিয়ে আসতে’… আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।

অর্থাৎ, মানবরচিত সিস্টেম (ধর্ম/মতবাদ) মানুষকে জুলুম করে, এমন সিস্টেম তৈরি করে, যাতে করে কেউ জালেম হয়, কেউ মজলুম হয়। জালেম নিজেও কোথাও মজলুম হয়। সকলেরই জীবন হয়ে পড়ে সংকীর্ণ, দমবন্ধ জীবন। সেই কারাগার থেকে আল্লাহর সিস্টেম/ দীনে তাদেরকে এনে ইনসাফের স্বাদ দেয়া, প্রশস্ত ইহজীবনের খোঁজ দেয়া এবং পরজীবনে মুক্তির সন্ধান দেয়া। এটাই ইসলামে যুদ্ধ/ ক্বিতাল/ জিহাদ-এর দর্শন। নতুন নতুন এলাকায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে, সেখানে মানুষকে (জালেম-মজলুম দুপক্ষকেই) ন্যায় ও মুক্তির দিকে আনা।

كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكْرَهُواْ شَيْـًٔا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيْـًٔا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (البقرة - 216)

তোমাদের উপর যুদ্ধ (কিতাল) ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন (কোনটি কল্যাণকর), তোমরা জান না।

সুরা বাকারা ২:২১৬

‘যুদ্ধ’ আমাদের শরীয়া, আমাদের ইতিহাস। ‘যুদ্ধ’ আমাদের আকীদাও বটে। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনটাই এতো বেশি যুদ্ধ-বহুল। যে সাহাবী-তাবেঈরা নবীজীর সীরাহ/ জীবনচরিতকে ‘মাগাযী’ (যুদ্ধগাঁথা) বলতেন। বড় বড় সব হাদিসের কিতাবে ‘কিতাবুল মাগাযী’ নামে সীরাহ-কেন্দ্রিক হাদিসগুলো স্থান পেয়েছে। আজ কারা একে ‘জঙ্গি-বাদ’ নাম দিয়ে ঘৃণা করতে বলে? কারা ‘জিহা-দ’এর সুস্পষ্ট পারিভাষিক ব্যবহারিক অর্থকে আভিধানিক অর্থের নামে অস্পষ্ট করে তোলে? কারা আমাদের আকীদা-শরীয়া-ইতিহাসকে ভুলে যেতে বলে? যারা মানবরচিত পাশ্চাত্য সভ্যতার (পুঁজিবাদী অর্থনীতি + ভোগবাদী জীবনধারা + হিউম্যানিজম ধর্ম + বস্তুবাদী দর্শন + ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-রাষ্ট্র) মুখপাত্র, তারা। যে ১% মানুষ কুক্ষিগত করেছে ৫০% সম্পদ, তারা। যারা আধুনিকতার নামে নারী-পুরুষ-শিশুদেরকে বায়োলজি-বিরুদ্ধ, সাইকোলজির বিপরীত কৃত্রিম জীবনব্যবস্থায় জিম্মি করে রেখেছে, তারা ও তাদের এজেন্টরা নিজেদের পথের কাঁটা দূর করতে ইসলামের ‘যুদ্ধ’কে ভিলেন হিসেবে প্রচার করেছে। এর প্রমাণ হল, ফিলিস্তিন-কাশ্মীর-আফগানিস্তানের ন্যায়সংগত প্রতিরোধ সংগ্রামকেও নিজ স্বার্থে ‘জঙ্গিবাদ’ নামে প্রচার করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

এজন্য ‘যুদ্ধ’-এর ব্যাপারে আমাদের আকীদা-বিধান-ইতিহাস চর্চা বাড়াতে হবে। কেননা ‘ইসলামে যুদ্ধ’ ধারণার অপব্যবহারও থেমে নেই। এর অপব্যবহার মূলত জিহা-দ এর ব্যাপারে সালাফগণের বুঝ গ্রহণ না করে, নিত্যনতুন মনগড়া অপব্যাখ্যা করার কারণে হতে পারে। আবার একে দানবরূপে দেখানোর চাল হিসেবে পুঁজিবাদী প্রভুরাই হয়তো এর অপব্যবহার করাচ্ছে, বা সামনে আনছে, এটাও অমূলক নয়। যাতে খোদ মুসলিমরাই একে ঘৃণা করে। সভ্যতার এই সংঘাতে মুসলিমরা যেন নিজেদের স্বকীয়তাকে ডিফেন্ড করতে না পারে। এজন্য ‘কিতাল’-এর বিধি সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলিমকে জানতে হবে, যেন

  • এক. সে ফরজ বিধানকে ভুল করে ঘৃণা না করে।
  • আর দুই. যেন এর অপব্যবহারের পাল্লায় না পড়ে।

ইতিহাসের দিকটায় শূন্যতা পূরণে সাদিক ফারহান ভাইয়ের এই অনবদ্য খিদমত আল্লাহ কবুল করুন। আশা করি বাকি দিকগুলোতেও আলিমগণ কাজ করবেন বাংলাতে। লেখক বদর থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত— ইসলামের ইতিহাসের সব যুদ্ধ এক মলাটে নিয়ে এসেছেন। কেবল বিজয়ের ইতিহাসই না, নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তার মত মুসলিমদের পরাজয়ের ইতিহাসও তুলে এনেছেন। সাথে জয়-পরাজয়ের কারণ-প্রেক্ষাপট-প্রভাব কিছুই বিশ্লেষণ করতে ছাড়েননি। কী পরিমাণ অধ্যয়নের ভিতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, তা শেষের গ্রন্থপঞ্জি দেখলে অনুভব করা যায়। আমরা যারা নিজেদের মুসলিম ভাবি, নিজেদের ইতিহাস নিয়ে দীন নিয়ে গর্বিত, বইটি আমাদের শেলফে যেন না থাকলেই নয়। মাকতাবাতুল আসলাফকে এমন মাইলফলক-টাইপ কাজ আনার জন্য জানাই মোবারকবাদ। লেখক-প্রকাশকসহ বইটির সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ উত্তম জাযা দান করুন।

<image1>

যুদ্ধ-ভাবনা
  • শান্তির সুশীল বাণী ছাড়বেন না। শান্তি আবার কী? পরম শান্তি বলে কিছু নেই। শান্তি সর্বদা একপাক্ষিক।
  • যুদ্ধ... The Male way to Negotiate. ড্রয়িংরুমে পাল্লা ভারি থাকার কৌশল।
  • যুদ্ধবাজরাই আমাকে 'শান্তি' বড়ি গিলিয়েছে, যাতে তারা আমার দিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়।
  • যুদ্ধ কখনও থামেনি। যুদ্ধ কখনও থামেনা।
  • যুদ্ধের স্বাদ নাও ইউরোপ। আমরা ও জিনিস পেট ভরে খেয়েছি।
  • 'মোসলমানের' আবার পক্ষ-বিপক্ষ কী?
  • হে পপকর্ন, দর্শক থেকে পারফর্মার হতে যেতে হবে বহুদূর।
  • ধ্বংস কি আলাদা কিছু? ধ্বংস আর সৃষ্টি এপিঠ-ওপিঠ।