কুমিল্লার হোমনাবাদ-পশ্চিমগাঁও এস্টেটের জমিদার নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি (১৮৩৪-১৯০৩) জন্ম নেন বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২) ৫০ বছর আগে। বেগম রোকেয়া যদি কট্টর মুসলিম পরিবেশে নারীশিক্ষার আন্দোলন করে থাকেন, তবে ৫০ বছর আগে আরও কট্টর পরিবেশ থাকার কথা। সেই পরিবেশে নারীশিক্ষার জন্য মেহনত করা আরও কঠিন হবার কথা। সেই সময় নবাব ফয়জুন্নেসা একের পর এক হতদরিদ্র লাগাতার দুর্ভিক্ষপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর নারীদের মাঝে শিক্ষা জন্য কাজ করেছেন।
এমন না যে মুসলিমরা ইচ্ছে করে মেয়েদের শিক্ষা দিত না মেয়ে বলে, যেমনটা বেগম রোকেয়া বলেছেন। বরং সেসময় বেঙ্গল প্রদেশে শিক্ষা ছিল এক বিলাসী পণ্য, ছেলেদেরও। অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল দিক নিয়ে নিঃস্ব অসহায় ঋণ-খাজনার ভারে জর্জরিত মুসলমান কৃষক মেয়েদের কেন, ছেলেদেরকেও শিক্ষিত করার কথা কল্পনা করতে পারত না। ১৭৭০ সালে মহাদুর্ভিক্ষে বাংলার ১/৩ মানুষ মারা যায়, প্রায় ১ কোটি (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর)। ১৮০১-১৯০০ পর্যন্ত ১০০ বছরে ৩১ টা মন্বন্তরে (মহাদুর্ভিক্ষ) ভারত জুড়ে মরে যায় ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ—‘না খেয়ে’। [১] সুতরাং মুসলমানরা শখের বশে মেয়েদের শেখাত না, ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না।
আর অভিজাত পরিবারে মেয়েদের উন্নত শিক্ষা দেবার চল ছিল মুসলমানদের মাঝে। এবং অভিজাত মুসলিম মেয়েদের বিয়েও হত দেরিতে (১৭-১৮ বছরে)। এই সময়টা তারা পিতৃগৃহে বিদ্যাচর্চার মাঝে কাটাতেন।

নবাব ফয়জুন্নেসাও ঘরোয়াভাবে শিক্ষিত ছিলেন। তাজউদ্দিন নামক গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি নানান বইপত্র পড়ে বাংলা-ফারসি-উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী হন। অভিজাত মুসলিম পরিবারে যে লেখাপড়ার চল ছিল, বেগম রোকেয়া নিজেই তার বড় প্রমাণ। এছাড়াও ১৮শতকে বেশ ক’জন মুসলিম নারী লেখিকার খোঁজ ইতিহাসে মেলে।

নারীশিক্ষা:
এরকম এক সময়ে বেগম ফয়জুন্নেসা কী কী করেছেন, ঠিক নাকি ভুল সে আলাপে আমরা যাব না।
• মায়ের জমিদারি পাবার (১৮৮৩) আগেই প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েদের হাইস্কুল (১৮৭৩)। এখন এর নাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা হাইস্কুল।
• আরেকটি স্কুল করেন, যার নাম আজ নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রি কলেজ
• তার জমিদারির ১৪টি মৌজায় ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারিতে একটিও স্কুল করার কথা নেই ইতিহাসে।
• মেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্থানীয়ভাবে হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন, জমিদারির আয় থেকে। মেয়েদের মাসিক বৃত্তি দেবার ব্যবস্থা করেন। [নওয়াব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ, রওশন আরা]
• মক্কায় অবস্থিত মাদরাসাতুল সাওলাতিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করতেন।
• পর্দানশীন নারীদের জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন (১৮৯৩)
• কেবল নারীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন, নওয়াব ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল।
• এছাড়া মসজিদ, রাস্তা, পুকুর নির্মাণ তো আছেই।
• বেশকিছু পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যেমন: বান্ধব, ঢাকাপ্রকাশ, সুধাকর, মুসলমান বন্ধু, ইসলাম প্রচারক ইত্যাদি।
• মৃত্যুর আগে তার সম্পূর্ণ সম্পত্তি জাতির জন্য দান করে যান।
• ২ বার বৃটিশ সরকার কর্তৃক ‘বেগম’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। ৩য় বার ‘নবাব’ উপাধি গ্রহণ করেন।





সাহিত্যচর্চা:
নবাব ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। সঙ্গীত বিষয়ে বেশ ক’টি বই লেখেন (তত্ত্ব ও জাতীয় সংগীত, সঙ্গীত সার, সঙ্গীত লহরী)। তবে তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ‘রূপজালাল’। কাব্যধর্মী এই বইটি ১৮৭৬ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মের ৮ বছর আগে প্রকাশিত হয়। তিনিই বাংলার প্রথম লেখিকা যিনি পূর্ণাঙ্গ বই রচনা ও প্রকাশ করেছেন। শিমাইল দেশের রাজপুত্র রূপজালালের সাথে রূপবানুর ও হুরবানুর প্রণয় কাহিনী এই বইয়ের বিষয়বস্তু। রূপজালালের বীরত্বগাঁথা ও দুই নায়িকার সাথে বিবাহের বর্ণনা রয়েছে এতে। ইংরেজি অনুবাদিকা Fayeza S. Hasanat (Brill থেকে প্রকাশিত) এর মতে এখানে ১৯শতকে মুসলিম নারীর পরাধীনতা ও যৌন-প্রতিরোধের চিত্র ফুটে উঠেছে। আবার উল্টোটাও বলা যায়।

১৯শ শতকের কলোনিয়াল ডিসকোর্স ছিল মুসলিম পুরুষরা কাপুরুষ ও পুরুষত্বহীন। আর মুসলিম নারীরা কামুকী, পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সঙ্গ কামনা করে। এর বিপরীতে ফয়জুন্নেসা 'রূপজালাল'-এ এক বলশালী পেশল মুসলিম পুরুষের চিত্র তুলে ধরেন, যারা বীরত্বে নারীকুল মুগ্ধ। বিপরীতে বেগম রোকেয়াকে আমরা দেখি প্রতিটি রচনায় মুসলিম পুরুষকে শাপশাপান্ত করতে। মূলত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেনের স্ত্রী বেগম রোকেয়া যেখানে কলোনিয়াল প্রভুদের সুরে সুর মিলিয়েছেন, সেখানে নবাব ফয়জুন্নেসা হেঁটেছেন উল্টোপথে।
একইভাবে তিনি মুসলিম পুরুষের একাধিক বিবাহকেও উপস্থাপন করেন, যেখানে স্বামী রূপজালালকে ইনসাফকারী হিসেবে দেখানো হয়, যেটা লেখিকা নিজের জীবনে পাননি। (স্বামীর ২য় স্ত্রী ছিলেন, পরে ডিভোর্স হয়ে যায়)। বেগম রোকেয়া তার লেখার ছত্রে ছত্রে ইসলামের বিধানকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মুহম্মদীয় আইন মূর্খ নারীরা মেনে নিয়েছে, পুরুষরা ধর্মশাস্ত্রগুলোর রচয়িতা ইত্যাদি বলে ইসলামের লেজিটিমেসি নষ্টের চেষ্টা করেছে সারাজীবন। সেখানে নবাব ফয়জুন্নেসাকে আমরা দেখি ইসলামের বিধান বাস্তবায়নের দায় দিয়েছেন পুরুষকে, ইসলামকে নয়।

বেগম রোকেয়া সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ধর্মীয় আইনের দৃষ্টিতে এটা সুস্পষ্ট ইরতিদাদ (ধর্মত্যাগ ও ব্লাসফেমি)। কখনোই 'মুসলিম' নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তাকে আনা যৌক্তিক না। তাহলে তসলিমা নাসরিনের কি দোষ।
প্রথমত, বেগম রোকেয়া তার কাজে বৃটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। কিন্তু তার কমপক্ষে ৩০-৪০ বছর আগে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ফয়জুন্নেসা যা করেছেন, তা অকল্পনীয়। বেগম রোকেয়ার চেয়ে বহুগুণ বেশি স্বীকৃতির হকদার। দ্বিতীয়ত, রোকেয়ার চিন্তাধারা জানার পর তাকে 'মুসলিম নারী' বলা যায় কিনা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে ইসলামের শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তৃতীয়ত, রোকেয়া যা করেছে তা হল: কলোনিয়াল লিটারেচার তৈরি করে বৃটিশের দালালের কাজটি করেছে। জাফর ইকবাল ও শাহরিয়ার কবিররা যেমন সংখ্যালঘু নির্যাতন, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি বলে বলে হাসিনার শাসন-জুলুমের বৈধতা তৈরি করতো। রোকেয়া সেভাবেই কাল্পনিক গালগল্প বলে 'মুসলিম পুরুষরা খারাপ' 'মুসলিম নারীরা পর্দায় কষ্টে আছে' ইত্যাদি বলে বৃটিশের 'সিভিলাইজিং মিশন' বা 'হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন' যুক্তিকে মালমশলা যুগিয়েছে। এটাকেই বলে কলোনিয়াল লিটারেচার। যেহেতু ভারতীয়রা অসভ্য, তারা নারীর সাথে আচরণ জানে না, তাই তাদের সভ্য করতে হবে। এজন্য দরকার সভ্যদের শাসন, বৃটিশের জয় হোক। বিপরীতে নবাব ফয়জুন্নেসা বৃটিশ বয়ানের বিপরীতে রচনা করেছেন।


বেগম রোকেয়া কখনোই মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হতে পারে না। ইসলামের বিধানে (পর্দা, জেন্ডার শ্রম বিভাজন) কুঠারাঘাত করার জন্য তাকে বৃটিশ ও নেটিভ স্লেভরা সম্মানের আসনে বসিয়েছে। এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝতে হবে। তার চেয়ে শিক্ষাবিস্তারে অনেক বেশি অবদান নবাব ফয়জুন্নেসার, আরও কঠিন সময়ে। সমস্যা হল নবাব ফয়জুন্নেসা নিজে পর্দা করতেন, বোরকা-নিকাব পরিধান করতেন (এটা আঁকানো ছবি, তাঁর ফটোগ্রাফ আছে নিকাবপরিহিতা, খুঁজে পেলে দিচ্ছি)। এজন্যই স্লেভ আর স্লেভমাস্টারদের চোখে তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত হয়ে উঠতে পারলেন না।
মুসলিম নারীরা প্রশ্ন করতে শিখেছে। বইয়ের মুখস্ত ইতিহাসের বাইরে চেপে রাখা গল্প শুনতে জেন-জি আগ্রহী। তারা দেখেছে কীভাবে পাঠ্যবইয়ে ১৬ বছর তাদের ছাইপাশ গেলানো হয়েছে ইতিহাসের নামে, সত্যের নামে। তাদের সামনে সত্য খুঁড়ে তুলে ধরলে তারা হয়ে উঠবে ইসলামের সৈনিক, বৃটিশের ত্রাস। ইনশাআল্লাহ।