[পর্ব ১]

লিবারেল মানদণ্ডে 'সম্মতি'-ই হল বৈধ-অবৈধের মাপকাঠি। সম্মতি থাকলে তাদের হিসেবে ব্যভিচার, সমকাম, শিশুকাম, পশুকাম ইত্যাদি বৈধ। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পারস্পরিক সম্মতিতে কারও ক্ষতি না করে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। আর সম্মতি না থাকলে বৈধ সম্পর্কের দাবিও হয়ে যাবে অবৈধ। আমরা একটু দেখব 'সম্মতির ইতিহাস এবং গতিদিক। সম্মতির এই মানদণ্ড ধ্রুব কি না, পুরো দুনিয়া মানতে বাধ্য কি না সেটা আগে আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন।

সম্মতি

বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেকে ক্ল্যাসিকাল গ্রেকো-রোমান সভ্যতার উত্তরাধিকারী মনে করে। পূর্ববর্তী আলাপে আমরা দেখেছি, কীভাবে মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাত ধরে এসেছে ফরাসী বিপ্লব। মধ্যযুগীয় আর্থসামাজিক কাঠামো (রাজতন্ত্র+সামন্ততন্ত্র+যাজকতন্ত্র+ধর্মীয় নীতিবোধ) উচ্ছেদ হয়ে ব্যবসায়ী শ্রেণীর আধিপত্য বজায় থাকে এমন কাঠামো গৃহীত হয়েছে (গণতন্ত্র+লিবারেল সমাজ+ধর্মনিরপেক্ষতা+লিবারেলনৈতিকতা+পুঁজিবাদ)। সমাজের গোষ্ঠীগত স্তরবিন্যাস (hierarchy) অবসান হয়েছে, যেটা আগে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করত। এখন এই নিয়ন্ত্রক ভেঙেচুরে দিয়ে বলা হয়েছে: প্রত্যেকে স্বাধীন ও সমান। এই লক্ষ লক্ষ সমান ও স্বাধীন (masterless) মানুষকে এখন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? এরই সমাধান দিতে আনা হল উদারনৈতিকতা বা লিবারেলিজমকে। সমাধানটা হল:

  1. প্রত্যেকে নিজের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাকে ভিন্ন ভিন্নই রাখবে।
  2. সম্মতি।

রোমান আইন অনুসারে volenti non fit injuria (to a willing person, no injury is done.); যে কাজ ভিকটিমের সম্মতি নিয়ে করা হয়, তা ক্ষতি না। সুতরাং যেহেতু তা কারও ক্ষতি করছে না, সুতরাং তা আইনত অপরাধ না; নৈতিকভাবে মন্দ না, অবৈধ না। সুতরাং সম্মতি-ই এই masterless মানুষদের পারস্পরিক ইন্টার‍্যাকশানের সীমারেখা। তাই কি? যেখানে সম্মতি আছে, সেখানে ক্ষতি নেই? সম্মতি নেই, আবার ক্ষতিও নেই এমন অনেক ক্ষেত্রও তো রয়েছে। চলুন দেখা যাক।

সমস্যা ৪

'সম্মতি' নিয়ে স্বেছাচারিতার আরেক নজির হল ধর্ষণের সংজ্ঞায়নে সম্মতির ধারণা। মিলনে সম্মতি না থাকলেই ধর্ষণ, ঠিক আছে। কিন্তু সম্মতি যে নেই, এর প্রমাণ কী?

সুইডেনের মতো কিছু অত্যাধুনিক দেশে ২০১৮ সালের নতুন আইনে বলা হয়েছে :

জোর করুক বা না করুক, হুমকি দিক বা না দিক, মনে মনে সম্মতি নেই, এমন সহবাস মানেই ধর্ষণ। ভিকটিমের পক্ষ থেকে শারীরিক প্রতিরোধ থাকা জরুরি না, এমনকি মুখে 'না' বলাও জরুরি না। (sex without consent is rape, even when there are no threats or force involved.) [১]

জোর করতে হয়নি, নারীর পক্ষ থেকে শারীরিক কোনো প্রতিরোধও নেই। এরপরও ধর্ষণ, কেননা মনে মনে তার সায় নেই। বা যদি ঘটনার ৬ মাস পর মেয়েটি বলে আমার সায় ছিল না, তা প্রমাণও করার প্রয়োজন নেই। নারী প্রমাণের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে? সুইডেনে এক লোকের ৮ মাসের জেল হয়েছে। তার অপরাধ হল:

সে আর ভিকটিম একই বিছানায় শুয়েছে। ভিকটিম বলে দিয়েছে: সে সেক্সে আগ্রহী নয়। একই বিছানায় শোবার সময় ভিকটিম কেবল অন্তর্বাস পরিহিতা ছিল। লোকটি এক পর্যায়ে সেক্স ইনিশিয়েট করে (ফোরপ্লে)। এসময় ভিকটিম নীরব ছিল, কোনো কথা বলেনি, প্রতিরোধও করেনি। কোর্টে সে জানিয়েছে, আমি নিথর-বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। আসামী বলছে, আমি আসলে ভেবেছি ঘুমন্ত বলে সাড়া দিচ্ছে না। পরে মনে হয়েছে ভিকটিমের শারীরিক সায় আছে। এক পর্যায়ে আসামী বুঝতে পারে ভিকটিমের সায় নেই, সে সেক্স বন্ধ করে দেয়।

এই নতুন অপরাধের নাম Negligent Rape, এর দায়ে আসামীর ৮ মাস জেল ও অন্যান্য অপরাধ মিলেঝিলে ২ বছর ৩ মাস জেল হয়েছে। মানে নারী যদি বলে আমার সায় ছিল না, তাহলেই বয়ফ্রেন্ড শ্যাষ, নারীর অপ্রামাণ্য স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ রয়েছে এই 'সম্মতি'র মারপ্যাঁচে। অত্যন্ত তরল ও অপব্যবহারযোগ্য একটি সংজ্ঞা।

সুইডিশ ইংরেজি পত্রিকা The Local জানাচ্ছে, নারীবাদী-মানবাধিকার এক্টিভিস্টরা এই আইনে খুব খুশি হলেও, Sweden's Council on Legislation জানিয়েছে: আইনটি খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ। [২]

ইসলামে দণ্ডবিধির ধারণা এতো ধোঁয়াশাপূর্ণ না। একজনকে শাস্তি দেবেন, অথচ তার অপরাধই স্পষ্ট না, ঘোলাটে অস্পষ্ট অপরাধে কাউকে শাস্তি দেয়া কীভাবে যৌক্তিক। এটাই নাকি আবার সভ্যতার আলামত। নারীর স্বেচ্ছাচারিতা নাকি সভ্যতা? অনেকটা এমন ইতিহাস ইহুদিদের উপর অনেক নির্যাতন করেছে, তাই ইহুদিদের জন্য সব কিছু জায়েজ। তেমনি পুরুষতন্ত্র নারীদের উপর পুরো ইতিহাসে বহু জুলুম করেছে, তাই নারীদের জন্য এখন যা ইচ্ছা তাই করা জায়েজ। নারীর স্বেচ্ছাচারিতাই স্বাধীনতা।

নারীর উপর জুলুম হয়েছে, হচ্ছে। তার সমাধানও আছে। স্বেচ্ছাচারিতা কোনো সমাধান না। অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে ‘জোর করা’ বা ‘অসম্মতি’। প্রমাণের ঊর্ধ্বে কেউ-ই না, এটাকে আইন বলে না।ব্যাপারটা আমরা আরেকটু বিশ্লেষণ করব।

চলবে…

বই : যুদ্ধ, মনস্তত্ব ও দক্ষিণহস্ত মালিকানা (প্রকাশিতব্য) । শুদ্ধি প্রকাশনী

রেফারেন্স:

[১] Press release from Ministry of Justice (26 April 2018). Consent – the basic requirement of new sexual offence legislation. Government Offices of Sweden.
Sweden approves new law recognising sex without consent as rape, BBC [24 May 2018]

[২] Catherine Edwards (12 July 2019), ‘Negligent rape’: Has Sweden’s sexual consent law led to change? The Local