বিশ্বদর্শন কী? যে চোখে আপনি বিশ্বকে দেখেন। এই বিশ্বচরাচরের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি বিষয়আশয়-কে আপনি যেভাবে দেখেন, যেভাবে নেন, যেভাবে বিবেচনা করেন— সেটাই আপনার বিশ্বদর্শন। ধরুন আপনি নিজে। আপনার বিশ্বদর্শন গঠন করেছে খানিকটা আপনার ধর্ম, খানিকটা আপনার পরিবার (বাবা-মা), আপনার শিক্ষকেরা, আপনার পাঠ্যবইগুলো, টিভি-প্রোগ্রামগুলো, যেসব পেপার-পত্রিকা আপনি পড়েছেন, যেসব বন্ধুবান্ধবের সাথে চলেছেন। এভাবেই তৈরি হয়েছে আপনার ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, চিন্তাচেতনা। আপনার নিজের বিশ্বদর্শন।

সমস্যা হল, আমাদের বিশ্বদর্শন যে বা যারা গঠন করে, তারা সবাই এমন একটা বিশ্বদর্শনের অংশ যা অপূর্ণাঙ্গ ও অপরিপক্ব। যা বহু মৌলিক প্রশ্নের উত্তরদানে অক্ষম। যেমন: জন্মের আগে আমি কোথায় ছিলাম, বা মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাব? মূলত এই দুই প্রশ্নের উপরই নির্ভর করবে আমার এই কাটানো জীবনটার উদ্দেশ্য কী হবে। শতভাগ মানবরচিত বিশ্বদর্শনের কাছে এর উত্তর নেই। কারণ এই ত্রিমাত্রিক বিশ্বের বাইরে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ত্রিমাত্রিক ব্যাখ্যা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। স্থান-কালের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি সামগ্রিকভাবে কিছু দেখতে পাই না। ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতের এক ছোট্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ এই বিশ্বদর্শন ট্রায়াল-এরর করে করে এগোয়। যে এররের মাশুল গিনিপিগ হয়ে চুকাতে হয় কোটি কোটি মানুষকে।

স্থান-কালের বাইরে দাঁড়িয়ে যদি কেউ এই জগতকে দেখত, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত যার সামনে একটা খোলা চিঠির অক্ষরের মতো একইসাথে বর্তমান। যিনি খোদ বানিয়েছেন ল’-অফ-ন্যাচার, খোদ নির্ধারণ করেছেন এই মহাবুনটের ধ্রুবকগুলো। কেমন হয়, যদি তিনি কোনো রাস্তা বলে দেন? যদি তিনি জানিয়ে দেন আমরা কোথায় ছিলাম, আবার কোথায় যাবো? জানিয়ে দেন অদেখা সেই জগতের খুঁটিনাটি। যিনি জানেন, তিনি কিভাবে মানুষ বানিয়েছেন। মানুষের বায়োলজি, সাইকোলজি, নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা সবকিছু। তিনি যদি দেন কোন ব্যক্তিব্যবস্থাপনা, কোনো পরিবার-ব্যবস্থাপনা? ১০০ জন মানুষের সামষ্টিক শরীর-মন কীভাবে ফাংশন করে, তা তাঁর অজানা নয়। তিনি যদি দেন কোনো সমাজ-ব্যবস্থাপনা, অর্থব্যবস্থা? ১ কোটি মানুষের শরীর একসাথে ফাংশন করানোর প্রক্রিয়াও তাঁর জানা। তিনি যদি দেন কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা-বিচার-ব্যবস্থা? তিনি যদি দেন কোনো বিশ্বদর্শন?

প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে, এমন কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন কিনা। বিজ্ঞান এই বস্তুবাদী বিশ্বদর্শনের এক মুখপাত্র। সে আপনাকে বড়জোর বলবে এই ঘটনাটা সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব কিনা। কিন্তু সে কখনোই আপনাকে বলবেনা যে স্রষ্টা নেই। কারণ এটা তার আওতার বাইরে। সুতরাং বিজ্ঞান সরিয়ে রেখে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে। কাজে লাগাতে হবে নিজের অনুভবকে এবং যুক্তিকে। এই নিখুঁত বিশ্ব, ত্রুটিহীন প্রাকৃতিক আইন, এই ব্যবস্থার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধ্রুবক, যা নড়ে গেলে সব ধ্বংস। কোষে কোষে এই জটিল আণুবীক্ষণিক ব্যবস্থাপনা। এসব ঝড়ে-বাতাসে-বজ্রপাতে সম্ভব? নাকি এক সূক্ষ্মদর্শী মহাপরিকল্পনাকারী থাকা অপরিহার্য। নিজের অনুভবে খুঁজে পেতে হয় সেই অনিবার্য, অপরিহার্য, অবশ্যম্ভাবী সচেতন সত্তাকে।

দ্বিতীয় যে সিদ্ধান্তে আপনাকে আসতে হবে তা হল, সেই সচেতন সত্তা কি বিবাগী, বৈরাগী, ভবঘুরে টাইপ? নাকি সযত্ন-সস্নেহ-মমতাময় কেউ? তাঁর সৃষ্টিশৈলী আপনাকে জানাবে তিনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেছেন, নাকি সযতনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিসেব করে পরিকল্পনা করে সৃষ্টি করেছেন। এই মহাসৃষ্টির মাঝে যে পরিকল্পনার ছাপ, যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেবনিকেশের ছাপ তাতে তাঁকে উদাসীন বিবাগী মনে হওয়া কষ্টকর। তাঁর সূক্ষ্মদর্শী ও উদ্দেশ্যময় হওয়া অনিবার্য।

তৃতীয়তঃ তিনি যদি সযতন মমতাময় সত্তা হয়ে থাকেন, তবে মানুষকে ক্ষতিকর নৈরাজ্যের মাঝে ছেড়ে দেয়া তাঁকে মানায় না। অবশ্যই মানুষের কল্যাণার্থে সঠিক পথনির্দেশ তাঁর পক্ষ থেকে আসার কথা। এটাও অনিবার্য। তিনি সযতনে উদ্দেশ্য নিয়ে বানিয়েছেন, অথচ মানুষকে তার নিজজ্ঞানের উপর ট্রায়াল-এররের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবেন, এটা হতে পারে না। এটা দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক।

এখন আপনাকে সেই মহাসত্য খুঁজতে হবে। এটা আপনার দায়িত্ব ও আপনার জন্য অপরিহার্য। আপনি যদি সেই বার্তা খুঁজে বের করতে না পারেন, তবে গিনিপিগ আপনি ধ্বংস। আপনার ইহকাল ভুলপথে চলে, ভুল বিশ্বদর্শনের ট্রায়াল-এররের মাঝে পড়ে ধ্বংস। আর মৃত্যুর পর কী হবে, তা তো আপনি জানেনই না। আপনার বিশ্বদর্শন তা আপনাকে জানাতে ব্যর্থ।

বস্তুজগতের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিন্ন বিশ্বদর্শনে বিশ্বকে চেনায় ধর্মগুলো। এখন আপনি বলবেন, ধর্ম তো বহু, সবগুলোই নিজেকে সত্য দাবি করে। ‘ধর্ম বহু, তার মানে সবই ভুল’— এটা যুক্তিহীন গা-বাঁচানো সিদ্ধান্ত। আপনার গা কিন্তু আসলে বাঁচছে না, উটপাখির মত মাথা গর্তে ঢুকালেই কিন্তু সমস্যা মিটছে না। ৭ মহিলা এক বাচ্চার মা দাবি করছে, অতএব এই বাচ্চার আসলে কোনো মা নেই— এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা মূর্খতা। আপনাকে তাহলে বিবেক-বিবেচনা দেয়া হয়েছে কীসের জন্য। এই সিদ্ধান্ত কুকুর-বিড়াল-গরু-ছাগলে মানায়, মানুষে মানায় না। অবশ্যই আপনাকে গা বাঁচাতে হলে এই বাচ্চার আসল মা খুঁজতে হবে। এই বাচ্চার যে একজন মা আছে, তা তো অনিবার্য। সেই মহাসত্য খুঁজে বের করার দায় খাঁড়ার মত ঝুলছে আপনার উপর। নইলে ইহকাল শেষ, পরকাল থেকে থাকলে তা-ও শেষ। খুঁজে আপনাকে পেতেই হবে সেই বিশ্বদর্শন।

খুঁজতে খুঁজতে ধরেন আপনি পেয়ে গেলেন এমন একজন মানুষকে, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় মিথ্যে বলেছেন, এমন কথা তাঁর শত্রুও বলতে পারেনি। মানুষ যে যে কারণে মিথ্যা বলে (সম্পদ, নেতৃত্ব, মর্যাদা, নারী); সেসব তাঁকে অফার করা সত্ত্বেও তিনি তা নেননি এক মহান মিশনের জন্য। কিছু একটা বার্তা পৌঁছানোর জন্য তিনি প্রাণের ভয়ও করেননি, প্রলোভনও নেননি। বরং এই বার্তা পৌঁছাতে গিয়ে ৩ গুণ বেশি শত্রুর সাথে লড়তে গিয়ে জীবন হুমকিতে ফেলেছেন, হেলমেট ভেঙে মাথার ভিতর ঢুকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন, ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের খেজুরপাকা গরমে পাড়ি দিয়েছেন ৬৮৭ কিলোমিটার (তাবুক)। রাতে লম্বা নামাযে রস জমেছে পায়ে। মাসের পর মাস ৯ পরিবারের কোনোটিতেই চুলা জ্বলেনি। পা টানটান করে শোবার জায়গাটুকু ছিল না ঘরে। এ জীবন পাবার জন্য কেউ মিথ্যা বলেছে, যুক্তিতে ধরে না। এসব স্রেফ পৌরাণিক উপাখ্যান নয়, এসব অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সাজানো পদ্ধতিতে যাচাইকৃত বর্ণনাপরম্পরা। প্রত্যেক বর্ণনাকারীর সততা বহুসাক্ষ্যে প্রমাণিত। বহুকাল পরে সংকলিত কোনো রূপকথা নয়। রীতিমত লাইভ লিখিত-চর্চিত-বর্ণিত তথ্য, যা ইতিহাসের কালপ্রবাহে হারিয়ে যায়নি এক মুহূর্তের জন্যও। এই মানুষটার সততা ও সত্যতা অস্বীকার করা যায় না, যুক্তিতে আসে না।

চতুর্থতঃ এই মানুষটা কী বলতে চাচ্ছিলেন? কী সেই বার্তা, যা না পৌঁছে দিতে তিনি বাধ্য ছিলেন? কী এমন বার্তা, যার জন্য এত কষ্ট ভোগ করা যায়, এত প্রলোভন পায়ে ঠেলা যায়, এতো ত্যাগ স্বীকার করা যায়? এবার বসুন সেই বার্তা নিয়ে। কাভার-টু-কাভার। এ তো এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্বদর্শন। জন্মের আগে কোথায় ছিলাম? মৃত্যুর পর কোথায় যাব? কেন এই অস্তিত্ব? এই যাত্রায় কারা কারা আমার বন্ধু, কারা শত্রু? কে তিনি, কী সম্পর্ক আমার সাথে তাঁর? কেন বানালেন আমাকে, কী চান তিনি আমার কাছে? সব। আছে ব্যক্তিজীবন পরিচালন-নীতি, পরিবারনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, যুদ্ধনীতি, আইন-বিচারনীতি, ব্যবসানীতি। যা যা লাগে মানুষের, সকল কিছুর মূলনীতি দেয়া আছে তাতে। এক আশ্চর্য গ্রন্থ, যার উদ্দিষ্ট সেকেন্ড পার্সন আপনিই। আপনাকেই বলা হচ্ছে কথাগুলো। যারা স্রষ্টাকে জেনে-মেনে জীবন কাটাতে চায়, এই কিতাব তাদের পথনির্দেশ, তাদের ওয়ার্ল্ডভিউ; এতে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। যে মানলো, সে বে৬চে গেল এই-ওই জীবনে। আর যে মানল না, তার জীবন গিনিপিগের জীবন— ‘উলাইকা কাল আনআম, বা হুম আদল্ল্‌’, কিংবা তার চেয়ে নিকৃষ্ট। তার মৃত্যুর পর অনন্ত আগুনে চিরযন্ত্রণা।

ইসলাম এক স্বতন্ত্র বিশ্বদর্শন। কোন ট্রায়াল-এরর করে মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে নয়। বরং যাঁর জ্ঞান কমপ্লিট, তিনিই দিয়েছেন এটা। ‘যিনি বানিয়েছেন, তিনিই কি জানবেন না?’। মানুষের বায়োলজি-সাইকোলজি, মানুষের বায়োসোশিওলজি, কালেক্টিভ সাইকোলজি, ইকোলজি সকল ফিতরাতের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন ফিতরাতী বিশ্বদর্শন। যা মেনে চললে শরীর-মন-সমাজ-বাজার-দেশ-পরিবেশ সবকিছু স্মুথলি চলবে, সব সমস্যার সমাধান হবে। জীবন হবে ফুরফুরে, জালেমের জুলুম হবে খতম, দুর্বল পাবে ইনসাফ। যেটা যেভাবে চলার, সেটা সেভাবে চলবে।


খ্যাতিমান অর্থনিতিবিদ ড. আসাদ যামানের “ইসলামী বিশ্বদর্শন: মডার্নিটি ও ইসলামের সংঘর্ষ” বইটি আপনাকে পরতে পরতে উন্মোচন করে দেখাবে সেই বিশ্বদর্শন। আর মানবরচিত বিশ্বদর্শনের অসাড়তা। অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল-রাইহানের হাতে পড়ে বইটি যেন বাংলা ভাষায় তার উপযুক্ত হকদাতার হাতেই পড়েছে। দর্শন ও অর্থনীতির পূর্বজ্ঞান থাকা বইটি অনুবাদের জন্য জরুরি ছিল। একাডেমিক ধাঁচের বইটিকে সাধারণের পাঠযোগ্য করতে অনুবাদকের কসরত প্রশংসার দাবিদার। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় টীকা দিয়ে আলোচিত বিষয়ের পূর্বজ্ঞান উপস্থাপন সেই চেষ্টাকে সার্থক করেছে।

প্রকাশক ফাউন্টেন পাবলিকেশন ইতোমধ্যেই নানান আন্তর্জাতিক একাডেমিক বই বাঙলাভাষী পাঠকের নাগালে এনে অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছে। এই বইটিও সেই মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করল। বই সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ উত্তম বদলা দান করুন। ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ‘নিছক ধর্ম’ থেকে ইসলামকে ‘বিশ্বদর্শন’ হিসেবে চেনানোর ক্ষেত্রে বইটি মকবুল হোক।

শামসুল আরেফীন
ঢাকা
১০.১০.২৪

ইসলামী বিশ্বদর্শন
ড. আসাদ জামান
অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল-রাইহান

|| সম্পাদকের কথা ||