আকবরের জীবনী, তার ভিতরে ধর্মীয় পরিবর্তন, পরিবর্তনের কারণসমূহ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লম্বা আলাপ হয়ে যাবে। খুব সংক্ষেপে বলে চলে যাই। আকবরের মাঝে পরিবর্তনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়।

  • প্রথম স্তর (১৫৫৬ – ৭৩),
  • দ্বিতীয় স্তর (১৫৭৩ – ৮০),
  • তৃতীয় স্তর (১৫৮০ – ১৬০৫)

প্রথম পর্বে

ব্যক্তিগতভাবে আকবর ছিলেন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান।

  • তিনি নিয়মিতভাবে নামাজ পড়তেন, নিজের হাতে মসজিদ পরিস্কার করেন।
  • হেজাজের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য তিনি হজ্জযাত্রীদের সঙ্গে ছয়লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন।
  • এই পর্বে আকবর তার দরবারের দুই প্রধান উস্তাদ আব্দুল্লাহ সুলতানপুরিশাইখ আব্দুন নবীর অনুরক্ত ছিলেন। আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আলেম। বৈরাম খানের পতনের পর তিনি দরবারের প্রাধান্য লাভ করেন এবং 'মখদুম-উল-মুলক' উপাধি অর্জন করেন। শাইখ আব্দুন নবী ছিলেন একজন বিদ্বান ধর্মতত্ত্ববিদ। আকবর তাঁকে 'সদর-উস্‌-সদর' (প্রধান আলিম) নিযুক্ত করেন। আকবর তাঁর কাছ থেকে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা শুনতেন।
  • এসময় আকবরের দরবার ছিল রক্ষণশীলদের প্রভাবাধীন।

দ্বিতীয় পর্বে (১৫৭৩ – ৮০)

আকবর নানান ধর্মীয় বিতর্ক আয়োজন করেন ও উপভোগ করতেন (তুলনীয় আজকের অনলাইনে নাস্তিকদের আলোচনা শুনে কিছু ভাই সংশয়ে পড়েন)। পড়াশোনাহীন আকবর সুফিজম, দর্শনের আলোচনা শুনতেন (Question of Sufism, scientific enquiries into philosophy and law were order of the day)।

১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে আকবর ফতেপুর সিক্রিতে তার প্রাসাদের কাছেই ইবাদতখানা বা উপাসনালয় স্থাপন করেন। এখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা হত। প্রথম প্রথম ইবাদতখানায় শুধু মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা শুধু আলোচনা করতেন, প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাত্রে আকবর এদের আলোচনা শুনতেন। এ ধরণের আলোচনার লক্ষ্য ছিল ২টি:

  • কৌতুহলী মানুষের কৌতুহল নিবৃত্ত করা এবং
  • অন্যধর্মের ওপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা

কিন্তু আকবর লক্ষ্য করল যে, আলোচকগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত। বিরোধী মতকে দমন করার দিকেই তাদের দৃষ্টি। আকবর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৫৭৮ খ্রীষ্টাব্দে ইবাদতখানার আলোচনা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। হিন্দু, জৈন, পারসিক ও খ্রীষ্টান পাদ্রীরা ধর্ম নিয়ে আলোচনার জন্য ইবাদতখানায় আসত। অংশ নিত:

  • হিন্দুপণ্ডিত পুরুষোত্তম ও দেবী,
  • জৈন গুরু হরিবিজয় সুরি, বিজয় সেন সুরি ও ভানুচন্দ্র উপাধ্যায়,
  • খ্রীষ্টান পাদ্রী ফাদার রুডালফো, আকোয়া ভিভা ও এন্টনি মনসেরাট
  • জরাথুষ্ট ধর্মের পণ্ডিত দস্তুর মাহিয়ারজি রাণা

আকবর চাচ্ছিল, আলোচনার মাধ্যমে  ধর্মতত্ত্ববিদরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান কমিয়ে আনবেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আর. পি. ত্রিপাঠি লিখেছেন: সহনশীলতা বাড়েনি, বরং অসহিষ্ণুতা বেড়েছিল (Instead of bringing credit, the Ibadat Khana brought growing discredt)। আকবরের ইবাদতখানার অসারতা উপলব্ধি করে বন্ধ করে দেন (১৫৮১)। শুরু হয় ৩য় পর্ব।

ইবাদতখানার আলোচনা আকবরের সামনে এই উপলব্ধি আসে: সব ধর্মের মধ্যেই কিছু না কিছু সত্য আছে, সব পথেই ঈশ্বর উপলব্ধি ঘটে। প্রথমে 'মজহর ঘোষণা'র মাধ্যমে আকবর নিজেকে ইসলামের সুলতান, বিশ্বাসীদের নেতা এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও মুজতাহিদ বলে ঘোষণা করল। এবং ২য় ধাপে দীন-ই-ইলাহি ধর্ম তৈরি করল। যা মাত্র ১৭ জন গ্রহণ করেছিল, যার মাঝে মাত্র একজন হিন্দু (বীরবল)।

কেন একসময়কার ধর্মপ্রাণ আকবর বিগড়ে গেল, সে অনুসন্ধানে যাচ্ছি না। ২য় পর্বে রাজনৈতিকভাবে সুন্নী মোগল প্রতিপক্ষদেরকে সরিয়ে দেন। উজবেক অভিজাতদের বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ক্ষমতার প্রয়োজনে সংখ্যাগুরু হিন্দু জনগোষ্ঠীকে কাছে টেনে নেবার প্রবণতা একটা কারণ হতে পারে (বর্তমান আমলের সাথে তুলনীয়)। দেখুন এই হীন চেষ্টা কীভাবে তাকে মুরতাদে পরিণত করেছে। আমাদের সব আলোচনা 'মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ' গ্রন্থ থেকে, যার রচয়িতা আকবরেরই (১৫৪২-১৬০৫) নিযুক্ত গ্র্যান্ড মুফতি আব্দুল কাদির বাদায়ুনী (১৫৪০-১৬১৫) রহ.। বর্তমানের সাথে তুলনা করে করে পড়তে হবে।

আকবরের শাসনে গরুর মাংস খাওয়া ও ঈদে গরু কুরবানি নিষিদ্ধ ছিল।

রমজানের রোজা এবং হজ্জ নিষিদ্ধ করা হয়।
আরবি পড়া ও শেখাকে অপরাধ গণ্য করা হত। আলিমদের অসম্মানিত ও মার্জিনালাইজ করা হয়।
মসজিদে আযান দেয়া ও জামাতে নামায পড়ার নিয়ম বন্ধ করা হয়েছিল। মুহাম্মদ, আহমাদ, মুস্তফা এসব নাম পরিবর্তন করানো হয়েছিল। দিওয়ানখানায় কারও সাধ্য ছিল না যে, প্রকাশ্যে নামায আদায় করে।[মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ ২/৩১৫]
দাড়ি কামানোকে ভদ্রতা মনে করা হতো।
হারেমে ও দূর্গে শূকর ও কুকুর রাখা হতো। ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে আকবর তাদের দেখতে যেত।
নামাযে সিল্কের পোশাক ও স্বর্ণ পরা বাধ্যতামূলক ছিল।
হিন্দুদের খুশি করতে বছরের কিছু সময় পশুহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। বহু পরিবারকে শাস্তি দিয়ে শেষ করে দেয়া হয়।
ইসলামের প্রতিটি বিধান, নবুওয়াত, কিয়ামত, হাশর নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হত। হাঙ্গামাবাজ-গরিব বেদুইনদের ধর্ম বলা হত। মিরাজ নিয়ে বিদ্রূপ করা হত। কুরাইশ কাফেলা লুণ্ঠন, ১৪ জন স্ত্রীগ্রহণ ইত্যাদি বলে নবিজী সা.-এর শানে নিকৃষ্ট বেয়াদবি করা হত। [আইন-ই-আকবরী ১/৫৬৪]

সম্রাট ঘরে-বাইরে সব সময় গঙ্গাজল পান করতেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণ পানির সাথে কিছুটা গঙ্গাজল মেশানো হত। [আইন-ই-আকবরী ১/৩৩]

হিন্দুদের একত্ববাদী ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, তারা শিরক করে না। [ঐ ৩/২]

বাদশাহ আকবর নিয়মিত ভক্তিভরে অগ্নিপূজা ও সূর্যপূজা করতেন। [ঐ ১/২৮, ৩/৩৮৪]


হিন্দুত্ববাদী এই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আল্লাহ পাঠান মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. -কে। তাঁর আসল নাম আহমদ আল-ফারুকী সিরহিন্দি (১৫৬৪-১৬২৫ খ্রিঃ)। আমরা দেখতে চাই, এই তীব্র হিন্দুত্ববাদের মুখে তিনি কি মেহনতটা করেছিলেন