দীনের খিদমত কী জিনিস? ধরেন, আমি ডাক্তার। এক হচ্ছে, আমি হালালভাবে ইনকাম করছি, যথাসাধ্য রোগীদের ফ্রী-ডিসকাউন্টে দেখছি, আলিম-উলামার পরামর্শে চলছি, আমলের সাথে দিন কাটাই। নিঃসন্দেহে আমার সওয়াব হচ্ছে, আমি আল্লাহর প্রিয় হচ্ছি। এবং হয়ত আখিরাতে মাফ পেয়েও যেতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা দীনের কী ফায়দা হচ্ছে? কেউ যখন জিগ্যেস করে: আমি দীনের খেদমত কীভাবে করতে পারি। তার মানে, সে নিজের আখিরাত গোছানোর বাইরেও 'দীনের খিদমত' করতে চাচ্ছেন। এমন কিছু, যার দ্বারা...

১. দীন শক্তিশালী হবে
২. দীনের উপর আঘাত প্রতিহত হবে
৩. দীন ছড়িয়ে যাবে
৪. দীন প্রতিষ্ঠিত হবে

আলিমগণ বাই ডিফল্ট দীনের খিদমত করেন। তাঁরা মাদরাসার মাধ্যমে দীন টিকিয়ে রাখেন, ওয়াজের দ্বারা দীনকে আমাদের মনে শক্তিশালী করেন, লেখনীর দ্বারা আঘাত প্রতিহত করেন, ময়দানের দ্বারা দীনকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের দুনিয়াদারিও ঘুরেফিরে দীনের খিদমত হয়ে যায়। কিন্তু আমরা 'লর্ড মেকোলে-র সন্তানরা' উপনিবেশী শিক্ষায় নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক-ফিতরাত সব বিগড়ানোর পর 'দীনের খেদমত' কীভাবে করব, এইটা হল প্রশ্ন।

এক হল, আমি কীভাবে জবাবদিহি বাঁচবো?
আর দুই হল, দীনের খিদমত কীভাবে করবো?

ডাক্তারি ঠিকমত করলাম, আমি জাহান্নাম থেকে বাঁচলাম। দীন কী খেদমত পাইলো? উত্তর দেবার আগে বুঝতে হবে, কী বলছি। মনের আবেগে একটা জবাব ছেড়ে দিলাম, আর হয়ে গেল, মানুষ এখন এতো বোকা নেই।

ব্যক্তিগত আমল, সাফ লেনদেন ইত্যাদির সাথে সামগ্রিক দীনের খিদমতও জরুরি। দীনকে শক্তিশালী করা, দীনের উপর আঘাত প্রতিহত করা, দীন ছড়িয়ে দেয়া, দীন প্রতিষ্ঠা করা কেবল আলিমদের দায়িত্ব নয়। সমান দায়িত্ব আপনারও। যেটা কখনোই আদায় হবে না, যদি আপনি শুধুমাত্র আপনার জীবিকার কাজটাতেই লিপ্ত থাকেন। আমি সারাদিন ডাক্তারি করলে আমার পকেট ভারি হবে। তাতে দীন শক্তিশালী হবে না, আঘাত প্রতিহত হবে না, দীন ছড়াবে না। তাহলে আমরা কীভাবে দীনের খিদমত করবো?

১.

সাধারণ পর্যায়ের দীনী ইলম অর্জন করতে হবে (পূর্ণ আলিম হওয়া জরুরি না)। ইলম আমাকে হক-বাতিল চেনাবে। শত্রু-মিত্র চেনাবে। মোটামুটি ইলম থাকলে আমি আমার খেদমতের জায়গাটা চিনতে পারবো। বিশেষ করে আমার সাবজেক্ট রিলেটেড ইসলাম কী বলে, সেটুকুর ব্যাপারে আমাকে গভীরভাবে জানতে হবে।

২.

নিজ সাবজেক্টে দক্ষ হতে হবে। আমার সাবজেক্টে পশ্চিমা বক্তব্য, তত্ত্বগুলো, সমালোচনা, ফাঁকফোকর সব জানতে হবে।

৩.

আমার সাবজেক্ট থেকে আমি ইসলামের দিকে তাকাবো। ইসলাম পূর্ণ জীবনবিধান। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়কে ইসলাম মানুষের গবেষণার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ইসলামের আলাপ হিউম্যান সায়েন্স (হিউম্যানিটিস) এর সাথে বেশি সম্পর্কিত। মানব পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র-বাজার-আইন। সুতরাং আর্টসের ছাত্ররা ইসলামের ভিতর বেশি ভালো দেখতে পাবেন। তুলনামূলক ভাবনাচিন্তার দ্বারা ইসলামী আইন, ইসলামী সমাজ, ইসলামী অর্থব্যবস্থা, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বয়ানকে শক্তিশালী করুন।

৪.

প্রযুক্তি/প্রকৌশল নিয়ে যারা পড়ছেন, সর্বোচ্চ দক্ষ হোন। যেকোনসময় আল্লাহ কাজে লাগাবেন।

.

চিকিৎসাবিদ্যা যারা পড়ছেন, পুঁজিবাদী একচেটিয়া বিগ ফার্মা মনোপলি ভেঙে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলুন। '৩য় বিশ্বের ডাক্তার', 'মুসলিম ডাক্তার' এই ব্যাপারগুলো '১ম বিশ্বের বস্তুবাদী ডাক্তার' থেকে ভিন্ন। (সামনে এগুলো নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে)। কিউরেটিভ মেডিসিনের চেয়ে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন ও সামগ্রিকভাবে সুস্থতা নিয়ে কাজ করুন। অসুখ হবার পর কী করবো, তার চেয়ে অসুখ হবার আগে নিউট্রিশন ও লাইফস্টাইল ফোকাস করে দুর্বার বিপ্লব গড়ে তুলুন।

৬.

আল্লাহ তাওফিক দিলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করুন। ভোগ সীমিত করুন। দীনী প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে প্রচুর দান করুন।

৭.

তাবলীগ প্রভৃতি দাওয়াহ-র কাজে সময় দিন।

৮.

গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তুলুন।

৯.

মাদরাসা, ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করুন।

১০.

এলাকায় এলাকায় কর্জে হাসানা ফান্ড গঠন করে এনজিওর হাত থেকে মুসলিমের ঈমান-আমল বাঁচান।

১১.

ক্যাম্পাসে দাওয়াহর কাজ করে উদাসীন সেক্যুলারিজমে আক্রান্ত ৮০% মুসলিম সন্তানের মনে প্রশ্ন জাগান। চিন্তার মেরুকরণ তৈরি করুন। বিকল্প সমাধান হিসেবে ইসলামের সমাধান ও যৌক্তিকতা তুলে ধরুন।

১২.

জীবন নিয়ে হতাশ সেক্যুলার বন্ধুদের উপর কাজ করুন। তাদেরকে হক্কানী তাসাউফের মেহনতকারী আলিমদের সংস্পর্শে নিয়ে যান। (যেমন: মুফতি দিলওয়ার সাহেব, মওলানা আবদুল মতীন সাহেব, প্রফেসর হামিদুর রহমান সাহেব, মওলানা উমায়ের কোব্বাদি, মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব প্রমুখ)

১৩.

রোগাক্রান্ত সেক্যুলার বন্ধুদের পাশে সময় দিন। বিপদে যে পাশে থাকে, বিপদ কেটে গেলেও আপনার কথা সে শুনবে। এই সুযোগে তাকে আল্লাহর সাথে জুড়ুন।

১৪.

শিক্ষকতা পেশায় যান ও পরবর্তী প্রজন্মের উপর কাজ করুন। ফিতনার ভিতর দিয়েই দাওয়াহর কাজ চলে। ফিতনার ভয় করা যাবে না। ফিতনার ভিতর দাওয়াহ চলবে। আর ফিতনা থেকে বাঁচতে নিজের খুঁটো বয়স্ক আলিমের কাছে রাখবো, যাতে তিনি টেনে তুলতে পারেন। ফিতনা ছিলো না এমন কোনো যুগ ছিল না।

১৫.

যত বেশি সংখ্যক মানুষকে সম্ভব ঈমানের তাঁবুর নিচে নিয়ে আসুন। যেভাবে সম্ভব। যেমন করে হোক। শেষ যুগে ঈমান-কুফরের তাঁবু আলাদা হবে (হাদিস)। আপনার তাঁবুতে লোক বাড়াতে হবে। ইমাম সাহেব এসে মুসল্লায় দাঁড়ানোর আগেই।

আলিমগণের স্বতন্ত্র কাজ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাঁরা তাঁদের মতো করে করছেন। কথায় কথায় 'আলিমরা কী করছেন' 'আলিমরা উদাসীন বলে সব শেষ হয়ে গেল' এসব বাচ্চামো করবেন না ভায়েরা। লক্ষ্য ও ক্ষেত্র নির্বাচন করে নীরবে কাজ করতে থাকুন, অন্যকে কাজ করতে দিন।