উদ্ভবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাকে তিনটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে ভাগ করে দেখা হয়:

  • প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০-১৩৫০),
  • মধ্যবাংলা (১৩৫০-১৮০০)
  • আধুনিক বাংলা (১৮০০-র পরবর্তী)

প্রাচীন বাংলা:

প্রাচীন বাংলার নিদর্শন যে চর্যাপদ, সেটা আসলে বাংলা ভাষা কিনা তা নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেক পণ্ডিত বলেছেন, এটা আসলে বাংলা-ই না। আসলে চর্যার পদগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের কবিদের দ্বারা লিখিত। এবং তাদের লেখায় তাদের নিজেদের অঞ্চলের ভাষারূপ বা উপভাষার প্রভাবই পাওয়া যাবে।

বিভিন্ন পণ্ডিত চর্যাপদের ভাষার সাথে অসমীয়া, ওড়িয়া, বাংলা ও মৈথিলী ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন ও নিজ নিজ ভাষার পূর্বসুরি হিসেবে একে দাবি করেছেন।।

অর্থাৎ এটা ঠিক বাংলা নয়, বরং ‘সৃজ্যমান বাংলা’ মানে অপরিণত বাংলা। ব্যাপক কনফিউশন তৈরি হয় বলে একে ‘সন্ধ্যা বা আলোআঁধারি ভাষা’ বলেছেন কেউ কেউ। অর্থাৎ এটা বাংলার এক্সক্লুসিভ উদাহরণ না। বরং বেশি সম্ভাবনা যে, এটা দাবিদারদের সবারই কমন পূর্বসুরি অপভ্রংশ ভাষা।

চর্যা রচনার সময়কাল খ্রিষ্টীয় ৬৫০-১২০০ সালে (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র মতে) বা ৯৫০-১২০০ সালের মধ্যে ( আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে)। আর যেহেতু চর্যা সবচেয়ে প্রাচীন, এর আগে আর কিছু নেই। তার মানে ১২০০ সালের আগে ‘বাংলা’ হিসেবে ধরা যায়, এমন কোনো নিদর্শন নেই।

একে যদি বাংলা ধরি, তবে ১২০০ সালের আগে বাংলার জন্ম হয়নি, মায়ের পেটে আছে (‘সৃজ্যমান বাংলা’ মানে অপরিণত বাংলা)। বাংলার গঠন সম্পূর্ণ হয়নি। বাংলা তখনও আলোআঁধারি। পাল সাম্রাজ্য এবং সেন রাজবংশের আমলে পাবলিকের ভাষা ছিল প্রোটো-বাংলা। ১২০৪ সালে কিন্তু বখতিয়ার খলজি এসে পড়ল বলে। তখনও মাঠে বাংলা নেই, আছে বাংলার আগের রূপ প্রোটো-বাংলা।

ধরে নিলাম চর্যা প্রাচীন বাংলা। ১২০০ সালের আগে এ অঞ্চলে লোকে ঐ অসম্পূর্ণ বাংলায়ই (প্রোটো-বাংলা) কথা বলত। ধরে নিলাম। তবু সে বাংলা এলিটদের মাঝে পাত্তা তো পেতই না, উল্টো রাজরোষের শিকার হয় বাংলা ভাষা। এই শিশু ভাষার সাথে আজকের ঠিকাদারি দাবিদারদের সম্পর্কটা লক্ষ্য করুন।

১.

উত্তর ভারতের আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে যে বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশ ঘটেছিল, তা পরবর্তীকালে নিষ্পেষিত হয়েছিল আর্য-ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী মৌলবাদীদের হাতে।

২.

দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আসা ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) কৌলিন্য ও বর্ণপ্রথা চালু করতে গিয়ে সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলা ভাষার চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে হিন্দু সেন আমল ছিল একটি ‘কালো’অধ্যায়।

৩.

সুতরাং প্রাচীন বাংলার যুগে বাংলাভাষী অনেকেই কাব্যচর্চা করতেন সংস্কৃতে। রাজা লক্ষণ সেনের রাজদরবারের সুপ্রসিদ্ধ বাঙালি কবিগণ (জয়দেব, উমাপতিধর, গোবর্ধন আচার্য, শরন, ধোয়ী প্রমুখ) সংস্কৃতেই কাব্য রচনা করেছেন।

এই আলোচনার উপসংহার হল, প্রাচীন বাংলার যুগে বাংলাকে আমরা অপরিণত (প্রোটো-বাংলা), শ্রীহীন ও পাত্তা-না-পাওয়া ভাষা হিসেবে পাই। আর সেন ব্রাহ্মণদের দমন পীড়নের মাঝেও কারা সে ভাষা টিকিয়ে রাখল দেখা যাক। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়,

"ইসলামের প্রভাবে প্রভাবান্বিত কিছু লোক বাংলার কোথাও কোথাও সেই প্রাকৃতধর্মী সংস্কৃতির ধারা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন"।

[ সুত্র : নীহাররঞ্জন রায় - বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬]

কার ঠিকাদারি কে খায়...

১ম পর্ব

৩য় পর্ব