আর্যরা এদেশে আসে খ্রিঃপূঃ ১৫০০ সালের দিকে। এর আগে নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এদেশে বাস করতো। দ্রাবিড়, কোল, মুন্ডা ইত্যাদি। স্থানীয়দের মুখে মুখে আর্যদের বৈদিক ভাষা (সংস্কৃত) বদলে ‘প্রাকৃত’ ভাষা হয়ে যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। প্রাকৃত ভাষা প্রধানত পাঁচ প্রকার।

  • মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত > মারাঠী
  • শৌরসেনী প্রাকৃত > হিন্দি
  • মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ > বাংলা, অসমিয়া ও উড়িয়া
  • অর্ধমাগধী প্রাকৃত (জৈনশাস্ত্রসমূহ এ ভাষায়ই রচিত)
  • পৈশাচী প্রাকৃত > পাঞ্জাবি

৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই ভাষাগুলো থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নব্যভারতীয় ভাষাগুলোর (ডান পাশের ভাষাটা) সৃষ্টি হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল।

সংস্কৃত ভাষার যে রূপটি (অর্থাৎ প্রাকৃত) ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, তা এক সময় শিথিল ও সরল হয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ ধারণ করে। সংস্কৃত নাটকেও দেখা যায় নীচ শ্রেণীর অশিক্ষিত পাত্র-পাত্রীর ভাষা প্রাকৃত। এ ভাষায় সাহিত্য রচনাও হয়েছে একসময়, যেমন: (ব্র্যাকেটে সংস্কৃত রূপ দেয়া হল বুঝার সুবিধার্থে)

  • - বড্ডকহা (বৃহৎকথা, ১ম শতক),
  • - গাহাসত্তসঈ (গাথাসপ্তশতী, ২য়-৩য় শতক),
  • - গউডবহো (গৌড়বধ, ৮ম শতক)

প্রাকৃতের উদাহরণ দিই আরেকটু। দেখুন কীভাবে সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত হয়ে আমরা বাংলা শব্দগুলো পেয়েছি।

মাগধি প্রাকৃতের (খ্রি.পূ ৬০০-খ্রি ৬০০) পরবর্তী স্তর মাগধি অপভ্রংশ এবং তৎপরবর্তী স্তর অবহট্ঠের মধ্য দিয়ে ৯০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বাধীন নব্যভারতীয় আর্যভাষারূপে বাংলার উদ্ভব হয়। উদ্ভবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাকে তিনটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে ভাগ করে দেখা হয়:

  • প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০-১৩৫০),
  • মধ্যবাংলা (১৩৫০-১৮০০) এবং
  • আধুনিক বাংলা (১৮০০-র পরবর্তী)।

এই আলোচনার উপসংহার এই যে, আজকের এই নেটের যুগে এসেও বহু মানুষের মনে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, বাংলা সংস্কৃত থেকে এসেছে। সুতরাং আমাদেরকে সংস্কৃতমুখী হতে হবে। সংস্কৃত শব্দ বেশি বেশি ব্যবহার না হলে সেটা প্রমিত বা সহীহ বাংলা হবে না। আদমশুমারির বদলে জনশুমারি, দাফনের বদলে সৎকার বা শেষকৃত্য, আল্লাহর বদলে সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যারিকেচার আমরা দেখতে পাই।

সংস্কৃত থেকে বাংলা আসেনি। সংস্কৃত কেবল লিখিত ও সাহিত্যের ভাষা ছিল। সংস্কৃতের সন্তান বাংলা নয়। সংস্কৃতের সন্তান প্রাকৃত। প্রাকৃতের সন্তান অপভ্রংশ। অপভ্রংশের সন্তান অবহটঠ। অবহটঠের সন্তান বাংলা। বাংলার দাদার দাদা হল সংস্কৃত। একটা রাফ টাইমলাইন বানিয়েছি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’-এ বলেছেন,

‘বাংলা সংস্কৃতির দুহিতা নয়, তবে দূর সম্পর্কের আত্মীয়া মাত্র।’

(বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত)

[২য় পর্ব]