এবার একটা গল্প শোনাই। ডাকাতে আমাকে অপহরণ করে দাস বানিয়ে দিল। আমার তল্পিতল্পা ঘাঁটতে গিয়ে সেই হারামী আমার দাদার দাদার এক পুরনো ছবি খুঁজে পেল। সে সিদ্ধান্ত নিল: এটা আমার বাপের ছবি। এবং আমি দেখতে যেমন, আমার এই চেহারাটা আসলে ভুল। আমার চেহারাটা আমার বাপের সাথে (আসলে আমার দাদার দাদা) মিল খাওয়া দরকার। তাই সে আমাকে প্লাস্টিক সার্জারি করালো। করিয়ে যতটা সম্ভব আমার চেহারা যেন ঐ ছবির মত দেখা যায়, সেই বন্দোবস্ত করল। কেমন লাগল গল্পটা।

এখন আমরা যে বাংলা ব্যবহার করি সেটা এই প্লাস্টিক সার্জারি করা বাংলা। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ‘বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন’। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নির্মম সত্য ও একাডেমিয়ায় স্বীকৃত ইতিহাস।

ক)

কোথায় ব্যবহারিক বাংলা থেকে বাংলার ব্যাকরণ লেখার কথা। তা না করে নাথানিয়েল হ্যালহেড এক্কেবারে ১৫০০ বছর আগের ধ্রুপদী সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে লিখলেন ‘বাংলার ব্যাকরণ’। সংস্কৃত উচ্চারণকে বাংলা উচ্চারণ হিসেবে ধরলেন। সংস্কৃতের সাথে সম্পর্ক না পেয়ে বিপুল সংখ্যক ফার্সি ক্রিয়াপদ (১১৮টা) বাদ দিলেন। হ্যালহেড বাংলাভাষীদের বাংলাকে বাতিল করে দিয়েছেন এই বলে:

“তাদের বর্ণ, বানানরীতি, শব্দচয়ন সবই ভুলভাল ও হাস্যকর। তারা না পারে শব্দ বাদ দিতে, না পারে বাক্য গঠন করতে, তাদের লেখায় ফার্সি-আরবি-হিন্দুস্থানি শব্দে ভর্তি”।

মানে বাংলাভাষীরা বাংলা পারে না। ওদের বাংলাকে সংস্কৃতের সাথে মিলিয়ে ঠিক করে প্রমিত করে দিতে হবে। বিদেশী প্রভুর নাক-উঁচা ভাব ও প্রাচ্যকে হেয় মনে করার প্রাচ্যবাদী মানসিকতা স্পষ্ট।

খ)

একই কাজ করলেন উইলিয়াম কেরি। ১৮০৫ সালে তিনি হ্যালহেডে ব্যাকরণের দ্বিতীয় এডিশনে তিনি চলিত উপাদান প্রায় সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে আবারও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে বাংলা ব্যাকরণকে ঢেলে সাজালেন। হ্যালহেড যেগুলো জায়গায় কথ্য বাংলা আমলে নিয়েছিলেন, উইলিয়াম কেরি সেগুলোকেও ‘বাংলার ভুল’ বলে আখ্যা দিলেন। সংস্কৃত রীতিকেই সঠিক বলে আরেক দফা সংস্কার করে দিলেন।

গ)

ফরস্টার তাঁর অভিধানে শব্দসংগ্রহের মূলনীতিই করেছিলেন তদ্ভব শব্দ রেখে আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দেয়া। উইলিয়াম কেরি তাঁর অভিধানের ভূমিকায় বলছেন:

“বাংলা ভাষার ৭৫% শব্দই সংস্কৃত (?), তাই এই অভিধানের প্রায় পুরোটাই সংস্কৃত থেকে নেয়া হয়েছে”।

দেখেন কিসব বাংলা শব্দ স্থান পেয়েছে এদের অভিধানে। এগুলো নাকি বাংলা শব্দ?

  • অব্যথা,
  • অমৎস্য,
  • দ্রব্যায়োজননিবর্ত্তক,
  • পাদাস্থিমধ্যবর্ত্ত্যন্তঃস্থ,
  • উদরস্থষ্কৃষকদ্যুক্তক্ষুদ্রাপ্লাবক।

মূলত রাজভাষা ফার্সির প্রতি ইংরেজের একটা বিদ্বেষ কাজ করেছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন: সাহেবরা সুবিধা পেলেই ফারসি-আরবি শব্দক বাদ দিয়ে বাংলা গদ্যের আকৃতি সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চাইতেন। শ্যামলকুমার চট্টোপাধ্যায়ও সংস্কৃত-প্রীতি ও ফারসি-বিদ্বেষকে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া বলেছেন।

বই: আত্মবিস্মৃত বাঙালি, রইসউদ্দিন আসাদ

এবং এই কাজে যবন ও যবন ভাষার প্রতি বিদ্বেষে সাহেব-পণ্ডিত ঐক্য পাওয়া যায়। হ্যালহেড পূর্ববঙ্গের মুনশিকে বাদ দিয়ে সংস্কৃত পণ্ডিতকে নিয়োগ দেয়। দুজনে মিলে প্লাস্টিক সার্জারি করতে থাকেন। আইনগ্রন্থগুলোর অনুবাদেও এই ঐক্যের নজির মেলে। ফরস্টারের মুনশিদের কাজে এই পরিবর্তন বেশ টের পাওয়া যায়। আইনের শেষে ছিল ‘খোলাষা’, ১৭৯৭ সালের অনুবাদে সেটা হয়ে গেল ‘সমাপ্ত’, ২/৩ বছরের মাঝেই সেটা হয়ে গেল ‘ইত্যবসান’। (গোলাম মুরশিদ, ১৩৯৯)

উইলিয়াম কেরি নির্ভর করতেন মৃত্যুঞ্জয় নামে এক পণ্ডিতের উপর। এই সব পণ্ডিতে ছুটি শেষে কাজে না ফিরলে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার প্রকাশই বন্ধ থাকত। এতোটা নির্ভরশীল সাহেবরা ছিলেন এই সংস্কৃত পণ্ডিতদের উপর।

সজনীকান্ত দাস লিখেছেন:

সাহেবরা সুযোগ পাইলেই আরবি-ফারসির বিরোধিতা করিয়া বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে ১০-১৫ বছরের মধ্যেই বাংলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছিল।

[সজনী ১৩৫৩: ২৮]

মানে ১৮১৫ সালের মাঝেই কলকাতার পত্রপত্রিকার বাংলা বদলে দেয়া হল। জন্ম নিল বাংলা গদ্য সাহিত্য। শ্রীরামপুরের মিশনারীরা এই বাংলাকেই একাধিক প্রভাবশালী পত্রিকা ও পাঠ্যপুস্তক রচনার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল। সাহেবদের চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করল— সংস্কৃতায়ন, দুর্বোধ্যতা, ইংরেজি বাক্যগড়ন, বাগবিধির বাড়াবাড়ি, মুখের ভাষার সাথে দূরত্ব। আনিসুজ্জামান লেখেন: ‘নতুন অভিভাবকতায়’ (ইংরেজের) বাংলা গদ্যের নবযাত্রা শুরু হয়।

তাহলে সেই আগের বাংলা কোথায় গেল? বাংলাদেশের হাওয়া-জলে বেড়ে ওঠা অকৃত্রিম বাংলা? বাঙ্গালির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অনুযোগ, প্রেম-বিরহের ভাষাটা? অকৃত্রিম, প্রাকৃতিক, অক্ষতযোনি বাংলা-টা?