বর্তমান বাংলা গদ্যধারার সাথে বাঙালির নাড়ির সম্পর্ক নেই। নাড়ির ভাষাটা কই গেল? সেটা ‘মুসলমানি বাংলা’ নাম ধারণ করে ‘গদ্য হিসেবে’ পরিত্যক্ত হল। কিন্তু পদ্য হিসেবে আরও একশ বছর টিকেছিল সেই বাংলা। যাকে আমরা ‘দোভাষী পুঁথি’ বা ‘বটতলার পুঁথি’ নামে চিনি।

যদিও এতে সংস্কৃতায়নের প্রতিক্রিয়ায় আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্য ছিল। ৩০-৪০% ফার্সি শব্দ ছিল এতে। (ছবিতে) মানুষের কথ্য ভাষায় এতো ছিল না। আবার যে ৬০-৮০% সংস্কৃত বাহুল্য ছিল গদ্যে, সেটার চেয়ে এটা ছিল গণমানুষের অধিক কাছের। এই ভাষার পাঠক ছিল পল্লী বাংলার অগণিত মুসলমান-হিন্দু ও শহর প্রবাসী মাঝি-মাল্লা, দোকানী-পসারী, দালাল প্রভৃতি। পাদ্রী Long-এর মতেও এই ভাষা (মুসলমানি বাংলা) নগরের অধিবাসী ও মাঝিমাল্লার মধ্যে বিশেষভাব প্রচলিত ছিল।

উইলিয়াম হান্টার এই ভাষার নাম দেন মুসলমানি বাংলা। যা ছিল নিম্নবঙ্গের (হুগলি, হাওরা, চব্বিশ পরগণা, কলকাতা, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল) মানুষের Lingua Franca বা চলভাষা। উইলিয়াম কেরিও লিখেছেন:

“উচ্চবর্ণের হিন্দুরা (কলকাতায় কেরির সহকর্মী সংস্কৃত পণ্ডিতরা) বাংলা বলে। আর নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানেরা বলে ‘হিন্দুস্থানি ভাষা’, যা বাংলা-ফার্সির মিশ্রণ”।

মানে আশেপাশের হিন্দু পণ্ডিতরা যা বুঝিয়েছে আরকি। যে, আমাদেরটাই বাংলা, আর ছোটোজাতেরটা ‘মুসলমানি বাংলা বা দোভাষী বা হিন্দুস্তানি ভাষা।

পুরো উনিশ শতক জুড়ে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজে এই ভাষার রচনা বিপুল পঠিত হয়েছে। কেননা কলকাতার নব্যশিক্ষিত শ্রেণী ছাড়া বাকি অধিকাংশ মানুষের কাছে এই নতুন গদ্য সুখকর কিছু ছিল না। এটা বঙ্কিমও স্বীকার করেছেন:

“বাঙ্গালার লিখিত ও কথ্য ভাষার যতটা প্রভেদ দেখা যায়, অন্যত্র তত নহে। বলিতে গেলে, কিছু কাল পূর্ব্বে দুইটি পৃথক ভাষা বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা”।

(বঙ্কিম ১৮৮৯: ৩৩৯)

কীভাবে বিলুপ্ত হল:

১৮০০ সালের পর থেকে পরবর্তী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, অক্ষয়কুমার প্রমুখ সাহিত্যিকের অক্লান্ত চেষ্টায় যখন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় গদ্যরীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হল এবং পাশ্চাত্য প্রভাব-পুষ্ট বাংলা কাব্যধারা পূর্ণ বিকশিত হল তখন বাঙালি মুসলমানও সেই স্রোতে গা ভাসায়। ক্রমে ক্রমে এক-দুইজন করে অধিকসংখ্যক মুসলমান নতুন এই ধারায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করলে দোভাষী পুঁথির লেখক সংখ্যা কমতে লাগে। আধুনিক বাংলায় শিক্ষিত মুসলমান ব্যাপক হারে কাব্য চর্চা শুরু করলে দোভাষি বাংলার ধারা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।

৪৭ এর পর (গৌড়বঙ্গ আর বাঙ্গালা-দেশ) দুই বাংলা আলাদা হয়ে গেলে, ঢাবি'র অধ্যাপক ড. হরেন্দ্রনাথ পাল ভেবেছিলেন হয়ত সংস্কৃত-বাংলার বদলে আবার ফিরে আসবে বৃটিশপূর্ব বাংলা ভাষা (ফার্সি-বাংলা)। সেজন্য তিনি লিখে ফেলেছিলেন ফার্সি-বাংলার একটি ব্যাকরণ ও অভিধান। পাকিস্তান সরকারের অস্থিতিশীলতা, অবহেলা ও অদূরদর্শিতায় সেই পাণ্ডুলিপি আর প্রকাশের মুখ দেখেনি। একটু দৃষ্টি পেলে হয়ত ইতিহাস অন্যরকম হতো। বরং সেই সংস্কৃত-বাঙলার প্রভাবই বহাল রইল। শিক্ষা-ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস চর্চায় বৃটিশদের ডিভাইড এন্ড রুল কাঠামোয় এলোনা কোনো পরিবর্তন।

তাহলে পুরো আলোচনার উপসংহার যদি টানি, বাংলা ভাষার জন্মের কোল ও শৈশবের খেলাধুলা (সুলতানি আমল), আকীকার নামকরণ (বাঙ্গালা), যৌবনের পরিপক্বতা (মোগল আমলে প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা) সবই মুসলিমদের হাতে। ছোটোবেলায় আমাদের ভুলভাল পড়ানো হয়েছে যে, শিক্ষিত মুসলমানেরা বাংলা বলতো না। হিন্দুরাই বাংলাকে আগলে রেখেছে। অথচ দোভাষী পুঁথির রচয়িতারা সবাই উর্দু-ফার্সিতে উচ্চশিক্ষিত। আর হিন্দু সেনদের হাতে বাংলার ভ্রূণ তো গর্ভপাতই হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। আর লালমুখো সাহেবদের নিয়ে হিন্দু পণ্ডিতরা প্লাস্টিক সার্জারি করে গণবাঙ্গালির অবোধগম্য এক কিম্ভূতকিমাকার বাংলা তৈরি করেছে, যাকে বাঙালিই চেনেনা।

ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনকে কেড়ে নিয়ে ১০০০ বছরের পুরনো দাদার দাদা সংস্কৃতের শব্দ বসানো হয়েছে ফার্সি ঝেঁটিয়ে। এর চেয়ে নিকৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা আর কি হতে পারে। মায়ের ভাষার উপর জুলুম, এর চেয়ে নিকৃষ্ট জুলুম আর কি। জালেম হিসেবে শুধু পাকিস্তানিদেরকেই চেনানো হয়েছে। ভাষার অস্থিমজ্জা বদলে দেয়া জালেমদেরকে আমরা চিনিনি। মাতৃভাষাকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ধর্ষণ করেছে সাহেব-পণ্ডিত মিলে, তার খোঁজ রাখিনি।

ভাষা যদি আত্মপরিচয় হয়, তবে আজ আমরা আত্মপরিচয় চিনে নিলাম। না স্থানিক জাতীয়তায় উচ্চ বর্ণহিন্দুর সাথে পূর্ববঙ্গবাসীর সম্পর্ক আছে, আর না ভাষিক বিবেচনায়। বাংলা ও বাঙালি কোনোটাতেই তাদের অধিকার নেই। কলকাতা আমাদের কিবলা না। সত্যিকার বাঙালি হয়ে উঠতে ইসলামকে-মুসলমানিত্বকে বিসর্জন দেবার যে ডাক আমাদের কালচারাল এলিটরা গত ৬০ বছর শুনিয়ে এসেছে, এখন সময় সেটা বদলে দেবার। বাঙ্গালি কালচার মানে পূর্ববঙ্গের মুসলিম কালচার। যার উপাদান দাড়ি-টুপি-বোরকা-হিজাব-পাঁচ ওয়াক্তের নামায-জুমা-ঈদ-দাফন-তারাবি। এগুলো এক তো ইসলামের হুকুম, দুই আমাদের কালচারও বটে। গত হাজার বছর ধরে আমাদের বাপ-দাদারা যা করে এসেছে, সেটাকে আমরা বিজাতীয় বলে কীভাবে ফেলে দিই? কারা ফেলে দিতে বলে? সেই কলকাতার দালালরা, সাহেবের বগলে বসে থাকা পণ্ডিত-জমিদারদের প্রেতাত্মারা। চিনে রাখুন এদের। এদেশের জল-মাটি-কাদার সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। গণতন্ত্রের নাম নিয়েও এদেশের মানুষের ভোটের দরকার এদের নেই। এদেশের মানুষের ট্যাক্স নিয়েও আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য এদের কাছে নেই। এরা হিন্দুত্ববাদী-বাম-কালচারাল এলিট জোট। এদেরকে আমাদের সমাজ থেকে বয়কট করুন, আমাদের সমাজ নষ্ট করতে দেবেন না। আমাদের সমাজের জন্য এদের কোনো মায়া নেই।

আমরা যখন বলি ছোটো পোশাকে আমাদের সমাজে নুইসেন্স করনা। এরা হাসে। কারণ এরা আমাদের সমাজ, আমাদের ভালোমন্দকে ঔন করে না। এদের কেবলা কলকাতা আর ইউরোপ। কেবলার জন্য এদের দরদ আমাদের চেয়ে বেশি। আমাদের সাথে এদের সম্পর্ক নেই।

ইসলাম আমাদের কালচারের ভিত্তি। শুদ্ধ হতে আমরা ইসলামের দিকেই ফিরব। যেমন: পীর-সুফিরা ও হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীররা কালচারকে ক্রমাগত শুদ্ধির দিকে নিয়েছে। শুদ্ধ হতে আমরা কলকাতার দিকে ফিরব না, যারা জবরদস্তি নিজেকে কিবলা দাবি করছে। বাঙ্গালা জাতিবোধ, বাঙ্গালা ভাষা কোনোটারই দাবি আমরা ছাড়বো না। এগুলো পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের। তোমরা নিজেদের বঙ্গীয়-গৌড়ীয়-সেন এসব বলো। খেলা বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের হবে না। খেলা হবে হিন্দু ও বাঙ্গালি ছেলেদের। কিংবা বঙ্গীয় ও বাঙ্গালি ছেলেদের।

সব বয়ান বদলে দেন। ইতিহাস কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেন। আত্মপরিচয় নিয়ে জোর গলায় বলে ওঠেন: দাঁদা, ভালো না লাগলে কলকেতা সলে যান।