উপনিবেশপূর্ব বাংলা ভাষা:
তের-চৌদ্দ শতক বাংলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। ১৪শ/১৫শ শতকে মুসলিম শাসনামলে ফারসি রাজভাষা হওয়ায় এবং এর বিশেষ মর্যাদার কারণে বাংলায় স্থান পায় প্রচুর ফার্সি শব্দ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেনের মতো বিদগ্ধ ভাষাতাত্বিকদের মতে বাংলা ভাষায় কমবেশি আড়াই হাজারের মতো আরবি ফার্সি শব্দ আছে।
ভাষার স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা ঘটেছে। কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এজন্য শুরু দিকের হিন্দু-মুসলিম উভয় সাহিত্যেই সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য ছিল, যেহেতু বাঙ্গাল ভাষার মূল ছাঁচ সংস্কৃত-প্রাকৃতের এবং লেখ্য ভাষা বলতে সংস্কৃতচর্চাই সেন যুগে চলেছে।
পরবর্তী ৪০০ বছর ধরে ক্রমে ক্রমে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের লেখাতেই আরবি-ফার্সি শব্দ-ক্রিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। বাংলার স্বাভাবিক বিবর্তন রূপ কেমন ছিল। মঙ্গলকাব্যের ভাষার নমুনা ছবিতে দেখুন। ফার্সি শব্দের প্রাবল্য লক্ষ্য করুন। যত দিন গেছে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রাবল্য বেড়েছে, কমেনি। এটাই ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন।
এভাবে হতে হতে ১৭০০ সালের পরে বাংলা ভাষা যে কথ্য ও লেখ্য রূপ পরিগ্রহ করল, তা হল প্রচুর ফার্সি শব্দবহুল বাংলা। এসময়কার শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র (অন্নদামঙ্গলকাব্যের লেখক) সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি কেন আরবি ও ফার্সি মিশ্রিত ভাষা লিখেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন:
মানসিংহ পাতশায় হইল যে বাণী।
উচিত সে আরবী পারসী হিন্দুস্তানী।।
পড়িয়াছি সেই মত বর্ণিবারে পারি।
কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি।।
না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।
অতএব করি ভাষা যাবনী মিশাল।।
অর্থাৎ, ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে লিখলে লোকে বুঝবে না। তা উপস্থাপন-অযোগ্য ও রস-বিহীন হয়ে যাবে। সেজন্য যবন-ভাষা মিশেল করে লিখেছি।
ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের ফলে বাংলা ভাষার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়, যার আন্তঃফলস্বরূপ আধুনিক বাংলায় প্রচুর আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দ প্রবেশ করে। ফলে বাংলাভাষা সুস্পষ্ট গঠন, কাঠামো, ভোক্যাব এবং মর্যাদা লাভ করে। মোগল আমলে প্রদেশের ভিতর সরকারি-বেসরকারি কাজে রাষ্ট্র-স্বীকৃত ভাষা ছিল বাংলা। সুরেন্দ্রনাথ সেনের সিদ্ধান্ত:
“বাংলাই যে তখন পূর্বোত্তর ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল,আমাদের সঙ্কলিত পত্রগুলি পাঠ করিলে তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না”।
(সুরেন্দ্রনাথ ১৯৪২: ৮৪)
এমনকি অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুরাও রাজভাষা ফারসির চর্চা করতেন; ফলে তাঁদের বাংলাও ছিল এই আরবি-ফার্সি সংবলিত বাংলা। লেখ্য সাহিত্যকে বাদ রেখে, আমরা মানুষের দৈনন্দিন কাজের ভাষায় নজর দিলে বুঝা সহজ। হলুদ মার্ক করা ফার্সি-আরবি শব্দ।
সুকুমার সেন একে হিন্দু-মুসলমানের ‘কাজের ভাষা’বা ‘ব্যবহারিক বাংলা’বলে অভিহিত করেছেন। ভারতচন্দ্র একেই ‘যাবনী মিশাল’ ভাষা বলেছেন, যে ভাষায় কাব্য না লিখলে লোকে বুঝবে না বলে তিনি ওজরখাহি করেছেন। যেমন এখন মার্কেট পাইতে হলে সাধু ভাষায় লিখলে চলবে না, চলিত ভাষাতেই লিখতে হয়।
১৮শ শতকে বাংলার এরকম ভাষা-পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হ্যালহেড তাঁর বাংলা ব্যাকরণে বলেন যে, বাংলা ক্রিয়ার সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক আরবি-ফারসি বিশেষ্য মিশ্রিত করে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই সুচারুরূপে বাংলা জানেন বলে গণ্য করা হয়।
আলোচনার উপসংহার হল, বাংলার জন্ম থেকে নিয়ে ইংরেজ শাসন অব্দি রাজভাষা ফার্সির অধীনে বাংলার বেড়ে ওঠা। তাই ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়া অনুসারেই হিন্দু-মুসলিম সকলেরই কথ্য ও অফিসিয়াল ভাষা ছিল বাংলা। শুরুতে সে বাংলা সংস্কৃত-নির্ভর হলেও ৪০০ বছরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা হয়ে ওঠে প্রচুর আরবি-ফার্সি সংবলিত। ১৮০০-এর আগে যে কথ্য-দাপ্তরিক-লেখ্য রূপ বাংলার পাওয়া যায়, সেটাই এই মাটির বাংলা। ১৮০০ সালের পর কী হল সেই বাংলার?
ছবি সংগ্রহ: মোহাম্মদ আজম, বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ।