১.২

 দ্বিতীয়ত, দ্বৈত সত্তা ব্যক্তি ও সমাজে স্ট্রেস তৈরি করে। মসজিদে ঢোকার সময় প্যান্ট বটানো, মসজিদ থেকে বের হবার সময় সচেতনভাবে প্যান্ট ঠিক করা- এই অন্তঃব্যক্তি সত্তা-বদলের বহুল চর্চিত উদাহরণ। এটা বুঝার আগে স্ট্রেস ব্যাপারটা বুঝা দরকার। বিজ্ঞানী ল্যাজারাসের transactional stress theory মতে স্ট্রেসের সংজ্ঞা হল: পরিবেশ ও মানুষের মাঝে এমন একটা সম্পর্ক, যখন মানুষ কোনোকিছুকে নিজের সাধ্যের বাইরে মনে করে। (Lazarus & Folkman, 1984). না চাইতেও তাকে যা করতে হয়, এই দ্বন্দ্বই স্ট্রেস। যখন সে ভিতরে চ্যালেঞ্জড অনুভব করে।

ফলে নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে ডিভোটী এবং একইসাথে বাইরে ধর্মহীন সেক্যুলার সাজিয়ে রাখা, সচেতনভাবে নিজের আত্মপরিচয়ের (global self) একটা বড় অংশকে (কারও ক্ষেত্রে প্রধান অংশ) লুকিয়ে রাখা ও জোর করে চেপে রাখার প্রবণতা ব্যক্তির মাঝে দ্বৈতসত্তা (identity conflict) তৈরি করে। তার উপর সেক্যুলার হবার ও ধর্মপ্রবণতা চেপে রাখার কনস্ট্যান্ট অবমাত্রার প্রেসার কাজ করে সেক্যুলার রাষ্ট্রে। ধর্মপরিচয় উল্লেখ, চিহ্ন-পোশাকাদি ধারণ, রুটিন ধর্মাচার ইত্যাদিকে নেগেট করা হতে থাকে। ব্যক্তিও সেক্যুলার পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কায় ক্রমাগত দ্বিধান্বিত থাকে, যা তৈরি করে স্ট্রেস। Poynter এবং Washington (2005) দেখাচ্ছেন খ্রিস্টান সমকামীর ক্ষেত্রে এই স্ট্রেস কীভাবে কাজ করে। ধর্ম ও সেক্সুয়ালিটি উভয় ক্ষেত্রেই তাদের কমিটমেন্ট তাদের মাঝে আত্ম-সংঘাত তৈরি করে। এক পরিচয়ের self আরেক পরিচয়ের মাঝে ফিট হয় না (Brewer 2001)। এটা নিয়ে আরও স্টাডির প্রয়োজন আছে। আপাত প্রস্তাবনা হল, আমাদের কল্পিত গণশরীরে স্ট্রেস কিংবা রাষ্ট্রের নাগরিকদের গণস্ট্রেসের মুকুটে আরেকটি পালক এবং দীর্ঘব্যাপ্তি (দিবাভাগের জাগ্রতাবস্থার বড় অংশ জুড়ে) সম্পন্ন স্ট্রেস তৈরি হল এই ব্যবস্থায়।

অনেকে বলতে পারেন, ধর্মরাষ্ট্রে অন্যধর্মের মানুষও কি এই স্ট্রেসে থাকতে পারে? হ্যাঁ পারে। তবে এই কথার দ্বারা সেক্যুলার রাষ্ট্র নিরপেক্ষ হয়ে যায় না। সেক্যুলার রাষ্ট্র নিজেই একটা পক্ষ। এক পক্ষের ভিতর আরেক পক্ষ স্ট্রেস অনুভব করবে। সংখ্যালঘুর জন্য সেক্যুলার রাষ্ট্রই পূর্ণাঙ্গ সমাধান কিনা, সেটা আরেকটা তর্ক। ভবিষ্যতে সেই তর্কে যাবার এরাদা রাখি। আপাতত প্রস্তাবনা হল, ইসলাম সংখ্যালঘুকে নিজ পরিমণ্ডলে নিজ ধর্মপালনের, নিজ ধর্মীয় আইন মোতাবেক শাসনের পূর্ণ অধিকার দেয়। তাদের আনুগত্য সাপেক্ষে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাদেরকে রাজনীতির বলি হওয়া থেকে রক্ষা করে। এখন যদি সংখ্যালঘু দাবি করে তার ধর্মোৎসব সার্বজনীন করে উদযাপন করার সুযোগ দিতে হবে (নিজ পরিমণ্ডলের বাইরে এসে), মুসলমানের টাকা দিয়ে তার মন্দির গড়ে দিতে হবে, মুসলমানের অর্থে তাকে পূজাপার্বণে বরাদ্দ দিতে হবে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র সেটা দেবে না। এখন সংখ্যালঘু কী চায়, সেটা তাদেরকে ঠিক করতে হবে। 

১.৩

সেক্যুলার রাষ্ট্র মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। বরং উচিত ছিল উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে ধর্মের রিওয়ার্ড-পানিশমেন্ট কনসেপ্ট ঢুকানো, যা তার সেমি-অটোমেটিক অংশে (লিম্বিক সিস্টেম) স্থায়ী ত্বরিৎ স্মৃতি (working memory) হিসেবে রয়ে যাবে। এজন্য চোখে-কানে-জবানে-জয়েন্ট মুভমেন্টে চিন্তায় ধর্ম ও ধর্মাচার থাকা দরকার ছিল, যা এই স্মৃতি গঠন করে। যে সেমি-অটোমেটিক স্মৃতি ব্যক্তির আচরণকে এমন সময়েও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, যখন তাকে দেখার কেউ নেই। ধর্ম তাকে এক সর্বময় জবাবদিহিতার আওতায় রাখে। এভাবে গণদেহকে ম্যানিপুলেট করে রাষ্ট্রের জন্য জনগণের আচরণকে অর্গানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়ে পড়ে সহজ। চলুন দেখি কিছু সমস্যা ও তার সমাধান ধর্ম কীভাবে করে।

এভাবে প্রতিটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যায় দেখানো যায়, ইসলামকে সিরিয়াসলি যারা পালন করে, তাদের মাঝে স্বতঃপ্রণোদিত সংযম থাকে যে কাজটা করে গণশরীরের লিম্বিক সিস্টেম অংশটা। কীভাবে ইসলাম এই ফাংশনটা করে সেটা প্রথমে আলোচনা করেছি, প্রবন্ধ শেষে হয়ত আরও স্পষ্ট হবে।

প্রস্তাবনা হল, রিওয়ার্ড-পানিশমেন্টে পদ্ধতিতে কাজ করা ব্রেইনের সেমি-অটোমেটিক অংশ লিম্বিক সিস্টেম মানুষের আবেগ, আচরণ ও মোটিভেশন নিয়ন্ত্রণ করে। এবং এই স্থানে ধর্মের (স্পেসিফিক্যালি ইসলামের) ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, যা করতে সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যর্থ। ধর্মহীন রাষ্ট্র ধর্মের এই শক্তিকে ব্যবহার করে না। আধুনিক কল্যাণ-রাষ্ট্র (নরওয়ে-সুইডেন ইত্যাদি) এই কাজ করতে কোটি কোটি ডলার খর্চা করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিল কুরতে পারে না, যা ইসলামী রাষ্ট্রে সম্ভব। এসব রাষ্ট্রপ্রকল্প গণশরীরের মেকানিজম ও চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ।      

২. নেশন-স্টেইট (জাতিরাষ্ট্র):

বিভিন্ন সামাজিক আচরণ বুঝার ক্ষেত্রে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্কের গঠন ও মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে স্টাডিকে বলা হয় ‘বায়োসোশিওলজি’, যা সোশিওলজির নবতর এক শাখা। গবেষকরা দেখেছেন, মানুষের শরীরে ডিফল্ট তাল মেলানোর বৈশিষ্ট্য (synchronizing) আছে যা গ্রুপ-সলিডারিটি বা সংহতি তৈরি করে। নবজাতক আমাদের কথায় বডি মুভমেন্ট দিয়ে তাল মেলায়। দু’জন মানুষ যখন কথা বলে, তাদের ব্রেইনের কারেন্ট (EEG) একই তরঙ্গে মিল খায়, যেন এটা একজনেরই রিডিং। এভাবেই আরেকজনের অনুভূতিকে বুঝা, সেটার সাথে এডজাস্ট করা এবং নিজেকে আরেকজনের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ফিট করার দ্বারা তৈরি হয় সামাজিক সংহতি, গড়ে ওঠে সমাজ। আর উল্টোটা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, যা সমাজকে ধ্বংস করে।

এর কারণ হিসেবে গবেষকরা তিনটে উপাদানের কথা বলেন: আমাদের ব্রেইনে মিরর নিউরন রয়েছে, যা অন্যের কথা-আচরণকে অনুকরণ করতে চায়। কারও আচরণ দেখে সেই আচরণ করার দিকে ঝুঁকে যায়। এজন্যই পরিবেশ দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়, এজন্যই নাস্তিকতা, সমকামিতা-সহ অন্যান্য অপরাধ সমাজে নর্মালাইজ হওয়াটা সলিডারিটি নষ্ট করে। যৌথ কার্যক্রম ও যৌথ চেতনা বুঝা ও করানোর কাজটা এই মিরর নিউরন করে থাকে (Pacherie & Dokic 2006)।  

দ্বিতীয়ত, তারা বলেন আমাদের নিউরনের নবগঠনের ক্ষমতা (plasticity). কেবল শিশুকালেই না, সারাটা জীবনই আমাদের ব্রেইন নিউরনগুলো নতুন অভিজ্ঞতায় নতুন কানেকশন তৈরি করে। পুরনো কানেকশন ভুলে যায়, নতুন কানেকশন নতুন চিন্তা-দর্শন-আচরণ এনে দেয়। এই অদল-বদল সবচেয়ে বেশি হয় ঐ যে সেমি-অটোমেটিক অংশে (subcortical circuit) (Davidson et al. 2000) । এখানে আপনি যেমন ইনপুট দিবেন, তেমন আচরণের দিকে সে ধাবিত হবে। এভাবেই পরিবেশ ও শিক্ষা আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

আর তৃতীয় উপাদান হল, আমাদের অবচেতনও নয়, বরং অচেতন বুদ্ধিবৃত্তি (the cognitive unconscious) । অর্থাৎ সেই সেমি-অটোমেটিক অংশ। Lakoff (2008) বলেন, আমাদের ৯৮% চিন্তা-সিদ্ধান্ত ঘটে এই সাবকর্টিক্যাল লিম্বিক সিস্টেমে। তাঁর মতে বিপুল সামাজিক আচরণ এই অংশে নির্ধারণ হয় যেমন: অচেতনে শেখা (implicit learning), অচেতনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ (social intuition), অচেতনে পছন্দ-অপছন্দ, অচেতন আবেগ ইত্যাদি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানুষের দেহগঠন ইনহেরেন্টলি বর্ণবাদী। সমগোত্রপ্রীতি, সমদলান্ধ আচরণ গভীর প্রভাব ফেলার সবরকম সামানপত্র মওজুদ আছে আমাদের ব্রেইনে। ফলে ছোট থেকে ছোট ব্যাপারেও আমরা সংহতি খুঁজে পাই ও দলাদলি শুরু করি। নেশন-স্টেট একে আরও উস্কে দেয়, যেখানে এই ফিচারটা নিয়ন্ত্রণ ও অবদমনের প্রয়োজন ছিল। যুগে যুগে আমরা দেখেছি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের উত্থান ও ভিনজাতির উপর তার নিষ্পেষণ। এই ব্যাপারটা দিয়েই আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন নাৎসীবাদী হলোকাস্ট, বর্তমান জায়নবাদী গণহত্যা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ কর্তৃক বিহারি গণহত্যা, CUP-এর তুর্কী জাতীয়তাবাদ কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যা।

নিজ জাতির ব্যাপারে এই অতি-অন্ধতা (chauvinism, jingoism) এই রেইসিজম নেশন স্টেটের ডিপরুটেড বৈশিষ্ট্য। যাদের শক্তি আছে তারা ভিনজাতির উপর এই শ্রেষ্ঠতা খাটায়। আমেরিকা পুরো বিশ্বের উপর, ফ্রান্স আফ্রিকার উপর, ভারত তার প্রতিবেশীদের উপর যা করে একে শুধু জিওপলিটিক্যাল ভাবলে পূর্ণচিত্র পাবেন না। আমেরিকার-ফ্রান্স-ভারতের সাধারণ জনগণের চিন্তা চিন্তাধারায় স্বশ্রেষ্ঠতা ও পরনিকৃষ্টতার প্রভাবকে কেবল জিওপলিটিক্যাল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর যে জাতি দুর্বল, তারা সেটা খাটায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতির উপর, যেমন রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের উন্নাসিকতা কিংবা বিশেষ কোনো জেলার প্রতি কুধারণা। এ কারণেই আমার কথা হল, নেশন স্টেটের ধারণা গণশরীরের গঠনে সামঞ্জস্যশীল না। আবার নেশন ধারণাকে পূর্ণ অবদমনও ব্রেইনের গঠনের সাথে যায় না। একে একটা সীমার মাঝে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেটা ‘সবাই মানুষ’ এই কনসেপ্ট দিয়ে বিলুপ্ত করা শরীর-বিরোধী অলীক চিন্তা। আবার এই জাতি ঐ জাতি, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি— এমন চিন্তাকে উস্কে দেয়াটা বিপজ্জনক। ফলে তাকে নেশনের চেয়ে বড়, কিন্তু ‘সবাই মানুষ’ এই চিন্তার চেয়ে ছোট একটা তুলনামূলক বড় পরিসর দিতে হবে, যার ভিতরে নিয়ন্ত্রিত বিকাশ হবে। ইসলামী রাষ্ট্র এখানে দেয় উম্মাহ কনসেপ্ট, খিলাফতের ধারণা। যা আদর্শের ভিত্তিতে ম্যাক্সিমাম মানুষকে ধারণ করে।  

৩. মডার্ন স্টেট

মডার্ন স্টেটের যে সর্বগ্রাসী চরিত্র, নিজেই ধর্ম হয়ে ওঠার যে ঐশ্বরিক প্রবণতা, তা নিয়ে একাদেমিয়াতে বিস্তর আলাপ জারি আছে। আধুনিক নানান প্রযুক্তির ব্যবহার রীতিমত তাকে অন্তর্যামী বানিয়ে তুলেছে। সমাজতন্ত্রের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা অস্বীকার যেমন তার পতনের অন্যতম কারণ হয়েছে, কেননা এটা গণশরীরের সাথে যায় না। একইভাবে মডার্ন ক্যাপিটালিস্ট স্টেটের ব্যক্তিগত জীবনে প্রাইভেসি অস্বীকারের প্রবণতাও তার পতন ডেকে আনবে। পার্থক্য এটাই, ঈশ্বর মাফ করেন, রাষ্ট্র মাফ করে না। গণশরীর একদিন এটা আর সইবে না।

মডার্ন স্টেটের এই টোটালিটারিয়ান চরিত্র গণশরীরের জন্য চূড়ান্ত স্ট্রেস তৈরি করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত না করেই কেবল সার্ভেইলেন্সের দ্বারা তাকে নিয়ন্ত্রণের পুলিশিং, সমাজ গঠন করে মানুষের কিছু প্রয়োজনকে সমাজের হাতে ছেড়ে দেবার অর্গানিক পদ্ধতি ধ্বংস করে সব দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া, এই অতিকর্মযজ্ঞের জন্য অতি-ট্যাক্স ব্যবস্থা, সম্পদের গ্যাপ বৃদ্ধি, অর্গানিক সম্পত্তিগুলো ব্যাংকের কব্জায় চলে যাওয়া ও ঋণের বোঝা বৃদ্ধি— সব মিলে গণশরীর ও গণমানস তীব্র স্ট্রেসের কবলে পড়ে। যদ্দরুন ক্রমাগত স্ট্রেস-ঘটিত রোগ আমরা বৃদ্ধি পেতে দেখি। লক্ষ্য করুন, স্ট্রেস-ঘটিত অসুখগুলোর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বাড়ছে।

Liyuan Pu et al. (2023), Projected Global Trends in Ischemic Stroke Incidence, Deaths and Disability-Adjusted Life Years From 2020 to 2030, Stroke, Volume 54, Number 5, pp. 1330-1339
Karen E et al. (2024), Forecasting the Burden of Cardiovascular Disease and Stroke in the United States Through 2050—Prevalence of Risk Factors and Disease: A Presidential Advisory From the American Heart Association, Circulation, Volume 150, Number 4, pp. e65-e88
Autoimmune diseases: Rising Incidence of Autoimmune Disorders 
[Bach JF. The effect of infections on susceptibility to autoimmune and allergic diseases. N Engl J Med. Sep 2002;347(12):911–920.]
Mental health problems: [Zach Rausch and Jon Haidt (Mar 29,  2023), The Teen Mental Health Crisis is International, Part 1: The Anglosphere]

এতো আধুনিক চিকিৎসা সত্ত্বেও অসুখগুলোর এই ঊর্ধ্বমুখী ট্রেন্ডই প্রমাণ করে স্ট্রেস বাড়ছে। আপনি অসুখের চিকিৎসা করতে পারেন, কিন্তু অসুখ ঠেকাতে স্ট্রেস ঠেকাতে যা করা দরকার, তা হল, স্ট্রেসমুক্ত পরিবেশ-পরিপার্শ্ব। সিস্টেম নিজেই যদি কনস্ট্যান্ট স্ট্রেস জেনারেট করে, তা উপরের চিত্রই প্রতিফলিত করবে। এই প্রাথমিক সম্পর্ক-নির্ণয়ের পর বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করছি।

৪. লিবারেল রাষ্ট্র:

মডার্ন স্টেট একই সাথে লিবারেল এবং টোটালিটারিয়ান। এর মানে কী? আপনি যখন লিবারেল অর্থনীতির কথা বলবেন, অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসাবান্ধব অর্থনীতি। তার মানে আপনি ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নিচ্ছেন। আবার আপনি টোটালিটারিয়ান হয়ে উঠতে চাচ্ছেন। তার মানে আপনি জনগণকে অসহায় বানিয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, যেখানে জনগণ বাধ্য ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের সেবা নিতে, পণ্য কিনতে। জনগণ বন্দি সিন্ডিকেটগুলোর কাছে, জনগণ বন্দি বিগফার্মার কাছে, শ্রমিক বন্দি ইন্ডাস্ট্রির কাছে। আমেরিকার সাবেক এটর্নি জেনারেল রামসি ক্লার্ক বলেই দিয়েছেন: আমেরিকান ডেমোক্রেসি আসলে প্লুটোক্রেসি (বণিকতন্ত্র)। ডেমোক্রেসির মধু কানে ঢেলে তারা গণসম্মতি নিয়ে নেয় নিজেদের পক্ষে, বণিকতন্ত্রের বৈধতা নিয়ে নেয়, বাইয়াত নিয়ে নেয়। এরপর আইনসভা আলো করে বসে থাকে গ্রুপ-অব-ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা, শেয়ার-হোল্ডারেরা; বসে থাকে উপদেষ্টা হয়ে। আইন করে নেয় নিজেদের পক্ষে, পাশ করে নেয় সুবিধাজনক সব পলিসি।

মিডিয়ারই মালিক এরাই ঘুরেফিরে। সংবাদ, বিনোদন, বুদ্ধিজীবিতার নামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আগ্রাসন চালিয়ে মানুষকে করে দেয় একাকী, এটোমাইজড। ধ্বংস হয়ে যায় সমাজ। যে প্রয়োজন সমাজ পূরণ করত নিখরচে, তা এখন ঐ ব্যবসায়ীদের ব্যবসাপণ্য। কিনতে হবে আমার পণ্য, নিতেই হবে আমার সেবা, আর কোনো উপায় নেই।

ব্যবসায়ী মানসিকতার একমাত্র মোটিভেশন হল মুনাফা। সে কখনই প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে না, সে চায় মার্কেটে প্রয়োজন থাকুক। মিটে গেলে তার লোকসান। প্রয়োজন টিকে থাকলে তার পণ্যের চাহিদা টিকে থাকবে। এজন্য একদিকে সে অসুখ উৎপাদন করে, অন্যদিকে ওষুধও উৎপাদন করে। দুটোই তার লাগবে। অসুখ এক্কেবারে সেরে যাক, এটা তার কাম্য না। সে পরিবার-সমাজ ধ্বংস করার সকল কৌশল করবে, আবার সেই একাকী মানুষের একাকীত্ব দূর করতে নিয়ে হাজির হবে সোশ্যাল মিডিয়া, চ্যাটিং অ্যাপ, পর্নোগ্রাফি, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, ওষুধ, এলকোহল, কাডলিং সার্ভিস, হুক-আপ কালচার। যা একাকীত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। স্ট্রেসমুক্তির সকল মেকানিজমকে সে প্যারালাইজ করে ফেলে কর্পোরেট কালচার দিয়ে। ধর্ম, স্ত্রী, সন্তান, ঘুম, খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম— কর্পোরেট কালচারে সে সময় কোথায়? University of Chicago-র Psychologist ও Social Neuroscience সাবজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা জনাব John Cacioppo সাহেব ‘একাকীত্ব’ নিয়ে গবেষণা করেছেন ৩০ বছর। তাঁর মতে, বিশ্বে পরবর্তী মহামারী হল একাকীত্ব।

সুতরাং, লিবারেল ডেমোক্রেসি হল ব্যবসায়ীদের শাসন। জনগণ হল জিম্মি। লিবারেল রাষ্ট্রের অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে জীবন টানবে গণশরীর।           

৫. ইসলামী রাষ্ট্র (ইমারাহ/খিলাফাহ):

উপরের ৪টি সেকশানে আমি চরিত্র ও ফলাফল বুঝাতে এভাবে আলাদা করেছি। আদতে উপরের সবগুলোই মডার্ন স্টেটের বৈশিষ্ট্য। একইসাথে সে সেক্যুলার, লিবারেল, মডার্ন নেইশন স্টেট। এবার সবগুলো ফলাফলকে একসাথে চিন্তা করুন গণশরীরে। ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে এই সমস্যাগুলো সমাধান করে, এবং গণশরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফিতরাতী সমাধান দেয়, এবং গণশরীরের মেকানিজম ব্যবহার করে, তা পৃথক প্রবন্ধে আলোচনার দাবি রাখে। ইতোমধ্যে আলোচনার ধারা থেকে বুঝা যাবার কথা ইসলাম কীভাবে কাজ করে একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে।  

আমি যে তথ্যপ্রমাণ সম্বন্ধ উল্লেখ করেছি, তা অপর্যাপ্ত। বিজ্ঞজন এই সূত্র ধরে আরও অগ্রসর হলে এই প্রস্তাবনাকে আরও শক্তিশালী তর্ক হিসেবে দাঁড় করানো সম্ভব। আমি নিজেও কাজ করার এরাদা রাখি। গঠনমূলক সমালোচনার দ্বারা এই তর্ককে এগিয়ে নিতে ও ফাঁকফোকর নিরূপণে বিজ্ঞ পাঠকের সহযোগিতা কাম্য।