হাতেম তাঈ-র নাম শুনেছেন সবাই। তিনি ইয়েমেনের তাঈ গোত্রের মানুষ। ধর্মে খৃষ্টান। তার ছেলে আদী ইবনে হাতিম খৃষ্টধর্ম থেকে নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে ইসলাম কবুল করেন। বড় সাহাবি হন, অনেক হাদিস বর্ণনা করেন। এমনকি নবিজির ইন্তেকালের পর তাঈ গোত্র মুরতাদ হলেও আদী রা. তো হনইনি, উল্টো তাঁর মেহনতে পুরো গোত্র আবার দীনে ফিরে আসে। বুখারি শরীফে আদী ইবনে হাতিম তাঈ রা. এর বর্ণিত একটি হাদিস আছে। চলুন দেখি হাদিসটি।

“আমরা নবী কারীম (ﷺ)– এর মজলিসে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে দুর্ভিক্ষের অভিযোগ করল। তারপর আর এক ব্যক্তি এসে ডাকাতের উৎপাতের কথা বলে অনুযোগ করল। নবী কারীম (ﷺ) বললেন, হে আদী, তুমি কি হিরা (Hirah, Iraq) নামক স্থানটি দেখেছ? আমি বললাম, দেখি নাই, তবে স্থানটি আমার জানা আছে। তিনি বললেন, তুমি যদি দীর্ঘজীবি হও তবে দেখতে পাবে একজন উট সওয়ার হাওদানশীন মহিলা হীরা থেকে রওয়ানা হয়ে বায়তুল্লাহ শরীফে তাওয়াফ করে যাবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করবেন না। কারো আশ্রয় দানের দরকার হবে না। (তিরমিযি)

আদী (রাযিঃ) বলেন, আমি নিজে দেখেছি, এক উট সওয়ার মহিলা হিরা থেকে ‘একাকী’ রওয়ানা হয়ে কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করেছে। সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না”। [বুখারি, হাদিস ৩৫৯৫]

দক্ষিণ ইরাকের হিরা শহর থেকে মক্কা ১৮৭০ কিলো। ডাকাতের উৎপাতের পরপরই নবিজি হিরা শহরের কথা উল্লেখ করেছেন কারণ তখন এই রাস্তায় লুটেরাদের দ্বারা ছিনতাই ও রাহাজানীতে পূর্ণ। [বিদায়াহ ৫/১৩০] ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে আবু বকর রা. এর শাসনে হিরা শহর বিজয় হয়। মাত্র কয়েক বছরের মাঝে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই বিপুল পরিবর্তন যে, একজন নারী প্রায় ২০০০ কিলো উটের পিঠে একাকী সফর করবে অন্তরে ধর্ষণ-ডাকাতির কোন রকম শঙ্কা ছাড়া।

হিরা থেকে মক্কা দূরত্ব

কয়েকদিন আগে দেখলাম খুব ভাইরাল হল, পৃথিবীতে সব পুরুষ হঠাৎ নাই হয়ে গেলে মেয়েরা কী করবে? এক মেয়ে বলেছে: রাতে একা একা একটু রাস্তায় হাঁটবো। কিছু সিম্প ছেলে আবার এটার জন্য পুরো পুরুষজাতিকে অপরাধী বানিয়ে দিল মেয়েদের এই সামান্য ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে না পারার কারণে। অথচ গবেষণা বলছে, নারীরা ধর্ষিতা হয় এইসব পরিচিত পুরুষের হাতেই যাদেরকে তারা নিরাপদ মনে করেছিল। ফ্রিমিক্সিং-সহশিক্ষা-সহকর্ম সেই সুযোগটা তাদের করে দেয়।

বিপরীতে ইসলাম মাত্র ৫-১০ বছরে সেই পরিবেশ তৈরি করেছে, যা ঐতিহাসিকভাবে ডকুমেন্টেড। ইসলামের রাষ্ট্রকল্প নারীদের জন্য নিরাপদ সেই ইমারাহ নির্মাণ, যেখানে ধর্ষণ-ইভটিজিং শূন্যের কোটায় থাকবে। এটা ইসলাম শুধু ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে করে না, শুধু পর্দার বয়ানের মাধ্যমে করে না। এটা বাস্তবায়ন হয় ক্ষমতার দ্বারা, যে ক্ষমতা থেকে ইসলামকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যারা বিচারে পার পেয়ে যেতে চায়, তারা ইসলামকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রেখেছে।

দেখুন উপরে বর্ণিত নারী কিন্তু শরয়ী নিয়ম মানেননি। মাহরাম পুরুষ ছাড়া সফর করেছেন। তারপরও তার জন্য ইসলামী ইমারাহ নিরাপদ। এজন্য কোন নারী বেপর্দা চলা, ওড়না ঠিকমত না থাকা এটা পুরুষের তাকানো বা টিজিং বা ধর্ষণের জাস্টিফিকেশন না। ইউরোপ-আমেরিকার ন্যুড বিচেও মুসলিম পুরুষকে নজরের হেফাজত করতেই হবে, ন্যুড বিচ অজুহাত হবে না।

আবার ইসলাম এই পরিবেশ কায়েম করেছে নারীদের সাহায্য ছাড়া নয়। নারীরা শালীন পোশাকের মাধ্যমে ইসলামের এই রাষ্ট্রকল্পকে সফল করেছে। এভাবে পুরো সমাজ সমন্বিতভাবে একটা প্রোজেক্ট বাস্তবায়ন করে। শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব আমাকে নিরাপত্তা দেয়া, আমার কোন দায়িত্ব নেই, এটা পরিণত মানুষের কথা নয়।

দীন একটা জার্নি। এখানে উত্থানপতন থাকে। আজ ব্যক্তি যা বোঝেনি, লেগে থাকলে ২ বছর পর সেটা স্পষ্ট বুঝে আসে। এখানে ফিতনা আছে, আজ যা বুঝেছে, ২ দিন পরে সেটা ভুলে যায়। গ্রাফটা কারও ক্ষেত্রে লিনিয়ার না, জিগজ্যাগ। সমাজের সকল মানুষ দীন পালনের নানান পর্যায়ে থাকে। সবাইকে নিয়েই সমাজ চলে। এজন্য নবিজি দীনকে কঠিন করতে নিষেধ করেছেন, সহজ করতে বলেছেন। কাউকে পর্দা করতে বলা, শালীন হয়ে চলতে বলার ঢঙ এটা নয়, এভাবে নয়। দাঈরা ইসলামের অবস্থান স্পষ্টভাষায় বলবে, যৌক্তিকতা-সৌন্দর্য বুঝাবে। যে যতটুকু মানলো, তাকে ওয়ার্ম ওয়েলকাম করবে। এই ওয়ার্ম ওয়েলকামের দরুন সে আরও অগ্রসর হবে দীনের পথে। দাওয়াহ বাই ডিফল্ট নরম কাজ, পরিস্থিতি একে কঠিন না করলে।

বনু কায়নুকার বাজারে এক মুসলিম নারীর পোশাক নিয়ে টান দেবার জন্য, তার বেপর্দা হতে দেখে মজা নেবার জন্য উপস্থিত মুসলিম যুবক সাথে সাথে এই ইহুদী ব্যবসায়ীকে কতল করে ফেলে। তখন ইহুদিরা পালটা সেই যুবককে শহীদ করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে নবিজি উৎখাত করেন বনু কায়নুকাকে মদীনা থেকে।

কা'ব বিন আশরাফ নামের এক ইহুদী কবিকে কতল করেন মাসলামা রা. কারণ সে নবিজিকে নিয়ে অশ্লীল কবিতা রচনা করতো। তার আরেকটা অপরাধ ছিল সে মুসলিমা নারীদেরকে নিয়েও অশ্লীল কবিতা রচনা করত।

মুসলিমা নারীর সম্মান আলাদা বস্তু। নবিজির সম্মানের মতোই মুসলিম পুরুষরা এইজন্য অকাতরে রক্ত ঢেলে দিয়ে রক্ষা করে নিজেদের নারীর ইজ্জত। এখন আমাদের নারীদের বেছে নিতে হবে, তারা মুসলিম সিংহদের রক্ষাবূহ্যে তাদের মাথার মুকুট হয়ে থাকতে চায়, যার অপমান তারা এক মুহুর্তের জন্যও সহ্য করে না। নাকি সুযোগসন্ধানী দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় ভুলে ফাঁদে পা দিয়ে বইতে চায় আপসোসের জিন্দেগী? যারা নিরাপত্তার কাগুজে বাঘ দেখিয়ে অবজেক্টিফাই করে আরও ভালনারেবল করে তোলে মেয়েদের।

ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা, প্রতিনিয়ত সমাজ-রাষ্ট্র দ্বারা শারীরিক-মানসিক জুলুম ইসলামপন্থীদের একটা ডিফেন্সিভ পজিশনে নিয়ে গেছে। সাপের ফণা তুলে বাঁচার চেষ্টার মত। প্রতিটি সিঁদুরে মেঘ দেখে তারা ডরায়, ঘর পোড়ার নিদারুন স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সুতরাং বিজয়ী ক্ষমতাশালী ইসলামের সবকিছু হয়ত আমাদের মাঝে পাবেন না। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে এটা আছে। প্র্যাক্টিসিং-ননপ্র্যাক্টিসিং-ফ্লাকচুয়েটিং নির্বিশেষে সকল মুসলিম এবং অমুসলিমের জন্য নিরাপত্তা, নিশ্চিন্ততা ও নির্ভরতার ইশতেহার ইসলামী রাষ্ট্রকল্প: ইমারাহ ও খিলাফাহ।