সংস্কৃতি কী?

আমরা যা, তা-ই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানে জীবন, জীবনপ্রণালী। নিঃসন্দেহে সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে ধর্ম। কেননা, একাদেমিয়া বস্তুবাদী হলেও মানুষ বস্তুবাদী না। শতভাগ বস্তুবাদী মানুষ আপনি পাবেন না। ধর্ম হিসেবে হাজির না থাকলেও অন্যকিছু হিসেবে মানুষের মাঝে ভাব হাজির থাকে। ধর্ম না থাকলেও কোনো না কোনোভাবে তার মেটাফিজিক্স থাকে, যা তার চিন্তাধারাকে চালনা করে, অর্থাৎ সংস্কৃতিকে শেইপ করে। সুতরাং ধর্মকে খারিজ করে শুধু নৃতাত্ত্বিক বিচারে সংস্কৃতির আলাপ তোলা একটা চোরামি। একাধিক নারীবাদী বই পড়লাম যেখানে গণহারে ধর্ম শব্দটাকে লুকিয়ে এথনিসিটি শব্দটা ব্যবহার করেছে, যেন ধর্ম একটা 'কিছুই না'।

ধর্মই খুব প্রকটভাবে হুগলি-ভাগীরথী নদীর এপার আর ওপারে একদম আলাদা সংস্কৃতি শেইপ করেছে। একদম জিরো থেকে। জিরোর আগে বাঙ্গালী শব্দটাই নাই। বাঙ্গালা ভাষাও নাই। সেই জিরো পয়েন্টের কথা বলতেসি।

কালো দাগটা ভাগীরথী নদী। আগে আরও পূর্বদিকে ছিল।

১.
পণ্ডিতরা সেই ভাষাটাকে বলেন প্রোটোবাংলা, সান্ধ্যভাষা, আলো-আঁধারি ভাষা, বঙ্গকামরূপী ভাষা। যা বাঙ্গালা হয় নাই এখনও। জিরোর আগে।
২.
বাঙ্গালা শব্দটাও নাই জিরোর আগে। হুগলি-ভাগীরথীর ওপারে 'রাঢ়' ও 'গৌড়', এপারে বঙ্গ-সমতট-হরিকেল-পুণ্ড্র। কোথাও বাংলা-বাঙ্গালা এসব নাই। ওপারে রাঢ়ী-গৌড়ী, এপারে বঙ্গী-পুণ্ড্রী।
৩.
ধর্মের কী অবস্থা। হিন্দু বলে কোনো শব্দ নাই। হিন্দু শব্দটাই মুসলমানদের দেয়া। সিন্ধকে আরবরা বলতো হিন্দ। সিন্ধুর পূর্বদিকে পুরোটাই হিন্দুস্তান। যারা বাস করে, তারা সব হিন্দবাসী, হিন্দুস্তানী।

তাহলে কী কী ধর্ম আছে এখানে?

  • আছে আর্যধর্ম (ব্রাহ্মণ্য ধর্ম/ বৈদিক), যার ভিতর এদেশীয় ভূমিপুত্র(দ্রাবিড়) কনভার্টরা শুদ্র হিসেবে স্থান পেয়েছে।
  • জাতপাত দেখে ভূমিপুত্রদের বিরাট অংশ কনভার্ট হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে।
  • ভূমিপুত্রদের বাকি অংশ (অন্ত্যজ শ্রেণী) নানান স্থানীয় ধর্ম পালন করে (অনার্য-অহিন্দু)। যেমন শিবপূজা, সূর্যপূজা, ইত্যাদি।

আর্যধর্মের মজার জিনিস হল, সে সবকিছুকে আত্মীকৃত কোরে তার পূজকদের শুদ্রে পরিণত করে। তাদের মূল দেবতারা হল মানুষরূপে প্রাকৃতিক শক্তি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বরুণ, পবন, অগ্নি এগুলো আর্যদেবতা। শিব-কালী ইত্যাদি অনার্যদের দেবতাগুলোও তারা নিয়ে নেয়। এবং তাদের পূজারীদেরকে শুদ্র শ্রেণীতে নিয়ে নেয়। বুদ্ধকে অবতার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদে ভুক্ত করে নিতে চায় বৌদ্ধদেরকেও।

আর্যধর্মের বিকাশ মূলত শহরকেন্দ্রিক। আর অধিকাংশ শহর হুগলি-ভাগীরথীর ওপারে। পাটলিপুত্র, কর্ণসুবর্ণ, নালন্দা, লক্ষণাবতী। এদেশীয় গেঁয়ো প্রোটোবাঙ্গালি শুদ্রই রয়ে গেল মোটাদাগে। একটা অংশ শুদ্রদের মধ্য থেকে 'নীচু ব্রাহ্মণ' হিসেবে স্বীকৃতি পেল আর্যদের থেকে। আমাদের ভাষাকে কটাক্ষ করে বলা হত 'পাখির ভাষা'।

ভাষাগত-ভূমিগত জিরো পয়েন্ট। তখনকার ধর্মীয়, সামাজিক বিন্যাসটা বুঝার আছে। হুগলি-ভাগীরথীর এপার-ওপার ভাষা প্রোটোবাংলা। ধর্মীয়ভাবে বিভক্তি আছে। সামাজিক বিকাশে বিভক্তি আছে। জিরোর আগে থেকেই। ভাষায় বিভক্তি আছে। প্রোটো বললেও ওপারে চর্চা হয় সংস্কৃত। এপারে হয় প্রোটোবাংলা চর্যাভাষা, যাকে ওপার নিষিদ্ধ করে দিল। বাংলা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যাবার ফতোয়া দিল। তারাই নাকি আজগে বিরাট বিরাট বাঙালি হয়ে বসেছে। আর আমরাই নাকি বহিরাগত। আমাদের বাকি তাগের অনুসরণ করে বাঙালি হতে হবে।

আমার বক্তব্য হল: মুসলিমরা আসার আগে থেকে হুগলি-ভাগীরথী নদীর এপার আর ওপার বিভক্ত। ধর্মচর্চায়, মেটাফিজিক্সে, ভাষাচর্চায়, সামাজিক অবস্থানে, মাতব্বরিতে। ওপারে আর এপারে সংস্কৃতি আগে থেকেই আলাদা। ওদেরটা রাঢ়ী-গৌড়ী, আমরা বঙ্গীয়। চাটগামীরা এজন্য আমাদের 'বইঙ্গা' ডাকে। মুসলমান আসার পর কী হলো? এপারে আমরা ইসলাম গ্রহণ করে আরও আলাদা হয়ে গেলাম। জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু হল:

রাঢ়ী-গৌড়ীদের সাথে বাঙ্গালীর টানাপোড়েন

১.
বাঙ্গালা শব্দটা মুসলমানরা দিল। বাঙ্গালাহ নামে সামগ্রিক রাজ্য গঠন হলো। বাঙ্গালী নামের একক পরিচয় শুরু হল।
২.
রাঢ়ী-গৌড়ীদের অত্যাচার থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্তি দিল। সংস্কৃতের বদলে বাংলা চর্চাকে উৎসাহ দিল সুলতানরা। ১৫০০ সালের মাঝে প্রোটোবাংলা পরিণত হলো পূর্ণাঙ্গ বাংলায়। আরবি-ফারসি শব্দ, ফার্সি বাক্যকাঠামো নিয়ে।
৩.
রাঢ়ী-গৌড়ীদের সংস্কৃতবহুল বাংলা, আর বাঙ্গালার আরবি-ফারসি বহুল বাংলাও আলাদা হয়ে গেল।
৪.
আমাদের পূর্বপুরুষরা মুক্তি পেল রাঢ়ী-গৌড়ীদের নাগপাশ থেকে, বর্ণপ্রথা থেকে, সতীদাহ থেকে, স্তনকর থেকে। সুফীদের হাতে দলে দলে মুসলমান হলো গ্রামেগঞ্জের শুদ্ররা, অন্ত্যজরা, বৌদ্ধরা, জৈনরা। পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত মেটাফিজিক্স।


যারা নিজধর্মে রইল তারা পেল নিজ ভাষায় শিক্ষাদীক্ষার অধিকার। রামায়ণ-মহাভারত বাংলা অনুবাদ হতে পারলো। নরকে আর যেতে হলো না। কৃতজ্ঞতা চাই না বাপু।

বৃটিশের সাথে সম্পর্ক গড়ে এই রাঢ়ী-গৌড়ীরা আবার আগের শক্ত পজিশনে চলে গেল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মওকায় আবার চেপে বসলো আমাদের মাথায়৷ জমিদার হয়ে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়ে তাদের মাথায় বাজ পড়লো। স্বদেশীর নামে সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠলো তারা। সূর্যসেন-প্রীতিলতা-ক্ষুদিরামরা রাঢ়ী-গৌড়ীদের হিরো, আমাদের না৷ রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপর জমিদারি করেছে। 'সোনার বাংলা' লিখেছে রাঢ়ী-গৌড়ীদের জন্য।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে স্থায়ীভাবে জমিদারি হারালো তারা৷ পাকিস্তান ভাঙার জন্য রাঢ়ী জমিদারসন্তানরাই গড়ে তুললো কমিউনিস্ট পার্টি৷ জমির জমিদারি হারিয়ে গড়ে তুললো কালচারাল জমিদারি। আবার চড়ে বসেছে বাঙ্গালাহর ঘাড়ে।

মিলিয়ে পড়ুন

বাঙ্গালা শব্দটাই ছিনতাই করেছে। রাঢ়ী-গৌড়ীরা নিজেদের বলছে বাঙ্গালী। সেই স্বদেশীর সময় জমিদারি বাঁচাতে নিজেদের বাঙ্গালি দাবি করা শুরু করে। আজও চলছে। তুমি কবেকার বাঙ্গালি হে! বাঙ্গালীর নামে নিজের রাঢ়ী-গৌড়ী ভাষা, মেটাফিজিক্স, কালচার চাপানোর চেষ্টা করে চলেছো! ভাষার মূল কাঠামো এক হলেও হুগলি-ভাগীরথীর এপার-ওপার কখনো এক ছিল না। এক নেই। এক হবেও না।

বাঙ্গালা ভাষার জন্মের শুরু থেকেই, বাঙ্গালা নামে দেশের জন্মের শুরুত হেকেই, বাঙ্গালা শব্দটার জন্মের শুরু থেকেই ইসলাম এপারের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিতে শেইপ করেছে। ইসলাম পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালি জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য গাঠনিক উপাদান। এখন আমরা দুটো কাজ করতে পারি:
১.
হয় আমাদের শব্দটা ওদেরকে ছেড়ে দিতে পারি। সেক্ষেত্রে এই ভূখন্ডের উপর ভূমিপুত্র হিসেবে আমাদের জাতিরাষ্ট্র কাঠামোয় আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি।
২.
না হয়, শব্দটা রিক্লেইম করতে পারি। জাতিরাষ্ট্র সীমায় কাজ করতে হলে এটা দরকার। আরব, পাঠান, বাঙ্গালী ইত্যাদি নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তা 'দাগ-কাটা জাতীয়তা'র মতো উম্মাহ কনসেপ্ট বিরোধী নয়। নয়তো অমুক ফারসী, তমুক রুমী ব্যাপারগুলো গৃহীত হতো না। বোদ্ধারা ভাবুন কী করবেন।

তবে আমাদের বাঙালি ছাড়াও একটা পরিচয় আছে, তা হল আমরা মুসলিম। আমরা 'বাংলাভাষী মুসলিম'। ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আলগা আদিখ্যেতা নেই। বাংলা।আমাদের ভাষামাত্র। আমাদের আইডেন্টিটি হল: আমরা মুসলিম, আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর গোলাম।

মুসলিম পরিচয় নিয়েই আমরা কাজ করবো।আমার দীন, আমার জমিন।