ছোটোবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া শত ভুল তথ্যের মাঝে একটা হল: পাকিস্তানিরা আরবি হরফে বাংলা চাপিয়ে দিতে চাইছিল। অথচ যখন থেকে বাংলা হরফে বাংলা লেখা শুরু হয়েছে (সুলতানী আমল) তখন থেকেই আরবি হরফে বাংলা লেখার ধারাও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চলেছে ৭০০ বছর। বাম-হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনে মুসলমানদের সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, মায়ের ভাষা বাংলার সেই বৈচিত্র্যময় রূপ আজ বিলুপ্ত। জানতে পড়ুন Usama Siraj ভাই সংকলিত নিচের লেখাটি।
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্য, এক সময় আমাদের বাংলা ভাষা উর্দু-ফার্সির মতো আরবি হরফে লেখা হত। উইকিপিডিয়ার তথ্যে বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছে ―
"আরবি বর্ণে বাংলা লিখন বা হুরুফুল কুরআনে বাংলা হচ্ছে বাংলা বর্ণমালায় আরবি ভাষার প্রতিবর্ণী লেখা। নবাবি আমলে বাংলায় এই পদ্ধতিতে লিখন প্রচলিত ছিল, যাকে পরবর্তীতে ভাষাবিদগণ 'দোভাষী বাংলা' নামে নামকরণ করেন। পাকিস্তান গঠনের পর পূর্ব বাংলায় এই লিখন পদ্ধতিটি আবার রাজনৈতিকভাবে আলোচনায় আসে। তখন এই ভাষাকে 'পাকিস্তানি বাংলা' বা 'পাক-বাংলা ভাষা' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিলো।
বাংলার নবাবী যুগে, মুসলিম পুথি লেখকদের মধ্যে এভাবে লেখার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। প্রায় সমস্ত মুসলিম বাঙালি পুথি লেখকরা কিছু হিন্দু লেখকসহ লেখালেখির এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। এবং ৭২টি পুথি তৎকালীন শৈলী অনুসরণ করে লেখা পাওয়া গেছে। যার মধ্যে আছে আলাওলের পদ্মাবতী, শাহ মুহাম্মদ সগীর এর ইউসুফ-জুলেখা, মুহাম্মাদ আলী কর্তৃক হাইরাত আল-ফিকহ, মুহাম্মদ ফাসিহ ইত্যাদি।
এর মধ্যে কিছু নমুনা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর-এর গ্যালারি-৩৩ (পাণ্ডুলিপি ও নথিপত্র) এ সংরক্ষিত আছে যার মধ্যে আছে শেখ মুত্তালিবের কেফায়াতুল মুসাল্লিন সহ (১৫৫৯) এবং মুহাম্মদ খানের "মাকতুল হুসাইন" (১৬৪৫)।
শেখ মুত্তালিব তাঁর কেফায়াত আল-মুসাল্লিন গ্রন্থের মুখবন্ধে এই বক্তব্যটি দিয়েছেন: আমি এই সত্য সম্পর্কে অবগত যে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বাংলায় লিখতে গিয়ে আমি সীমাহীন পাপ করছি।
১৯৪৭-এর পর নব্য পাকিস্তান শাসনামলে এ শৈলীতে লেখা―
পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই নব্য পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের পক্ষে একদিকে ধর্মীয় আবেগ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সংহতির যুক্তি ছিল। বলা হচ্ছিল, উর্দু ছাড়া পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ভাষায় আরবি হরফ যেহেতু ব্যবহৃত হচ্ছে—এখন বাংলায় এই হরফের প্রবর্তন করলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক সংহতি দৃঢ় হবে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কমিয়ে তার পরিবর্তে আরবি ফারসি উর্দু ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা সচিব বা শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি পূর্ব বাংলার শিক্ষাবিদদের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে করাচিতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষা সচিবের এ প্রস্তাব করেন। ১৯৪৯ সালের পেশোয়ারে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায়ও আরবিকে পাকিস্তানের ভাষা সমূহের একমাত্র হরফ করার জোর সুপারিশ করা হয়। ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের দ্বিতীয় অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, একই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পথে যেসব অসুবিধা আছে তার মধ্যে নানারকম হরফের সমস্যাটি অন্যতম। এ প্রসঙ্গে তিনি আরবি বর্ণমালার উপযোগিতার কথা বর্ণনা করেন। এ ভাষাকে অনেক একাডেমিক ব্যক্তিত্ব পাকবাংলা ভাষা ও সেসময়ের মুসলিম বাংলা সাহিত্যকে পাকবাংলা সাহিত্য নামে উল্লেখ করেছেন। যখন ফজলুর রহমান ভাষার ইসলামিকরণের স্বার্থে বাংলাকে আরবি লিপিতে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন।
[ উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে ]
আরিফ খান সা'দ লিখেন―
১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৈয়দ সুলাইমান নদভী রহ.-কে আনা হয়েছিল একটি সেমিনারে। তিনিও সেখানে বলেছেন। ভাষণ শেষে বের হওয়ার সময় তাকে মারধোর করা হয়। ড. শহিদুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখদের চেষ্টায় ছাত্রদের রোষ থেকে রক্ষা পান। সে ভাষণ মুদ্রিত আকারেও ছাপা হয়েছে।
আলাওলের পদ্মাবতিও আরবি হরফে লেখা, সৈয়দ আলী আহসান ভূমিকায় এরকম অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেক বই আরবি হরফে লেখা। শাহবাগ জাদুঘরের তৃতীয় তলায় এরকম অনেকগুলো বই আছে। বর্তমান বর্ণমালা বিন্যাস করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ফোর্ট উইলিয়ামে, ১৮১৮ সালে। তখন থেকে আরবি হরফে লেখা বাংলা সাহিত্যকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘দোভাষী পুথি’, ‘বটতলার পুথি’ ইত্যাদি নামে। দোভাষী মানে হচ্ছে, ভাষা বাংলা কিন্তু বর্ণমালা আরবি। এরকম দোভাষী পুথি শত শত হাজার হাজার স্তুপ হয়ে আছে বিভিন্ন আর্কাইভ ভবনে, ঢাবির পাঠাগারে, বরেন্দ্র জাদুঘরে।
সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভীর দৃষ্টিতে বাংলা ভাষার লিখন পদ্ধতিকে আরবি হরফ থেকে সরিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে নিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তটি ছিল এ অঞ্চলের মুসলিমদের ধর্মীয় সত্ত্বার জন্য চরম আত্মঘাতি। এই এক সিদ্ধান্তের ফলে এতদাঞ্চলের বিশাল এক জনগোষ্ঠী আরবি হরফে লেখা ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুবিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে 'আজনবি' হয়ে যায়।
হুবহু এই চক্রান্তটা হয়েছিল তুর্কি ভাষা নিয়েও। হাজার বছর পর্যন্ত যে তুর্কি ভাষা আরবি হরফে লেখা হত, কামালবাদের এক ধাক্কায় সেই ভাষার লিখনশৈলি আরবি হরফ থেকে সরিয়ে রোমান/ইংরেজি হরফে নেয়ার ফলে সেখানকার বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে, হাজার বছরের ইসলামি সুবিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে অপরিচিত বানিয়ে দেয়া হয়েছে।