রাজা বাদশাহের নাম মুসলমান নাম দেখলেই ‘বহিরাগত’ ভাবার প্রবণতা পাশের দেশের একটি দলের (বিজেপি) নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেন,
“প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে মুসলমান বহিরাগত এবং যেহেতু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র সেহেতু ভারতবর্ষের মুসলমানদের উচিত পাকিস্তানে চলে যাওয়া। নতুবা, ভারতবর্ষে নেহাতই যদি তাঁরা থাকতে চান তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ও ‘অভারতীয়’ সংজ্ঞা বহন করে চলতে হবে। ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দুই এখানে প্রথম শ্রেণির নাগরিক এবং হিন্দুই একমাত্র খাঁটি ভারতীয়। বছর দশেক আগে প্রথম বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যে বিরাট সমাবেশ হয় দিল্লিতে, তখন চার-পাঁচ হাত লম্বা অক্ষরে দিল্লির ইতস্তত বিরাট দেওয়াল জোড়া বিজ্ঞপ্তি (ইংরেজিতে!) দেখা যায়; ‘ভারতবর্ষে সকল অহিন্দুই অভারতীয়’ (All non-Hindus are aliens in India)। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, যাঁরা জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে ভারতবাসী, যাঁদের পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হিন্দু- তাঁরা, তেরো-চোদ্দোশো বছর আগে তাঁদের ধর্ম নিয়ে কিছু মানুষ ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন বলেই অভারতীয়। এ সংজ্ঞাকরণ যে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন তা স্পষ্টই প্রতীত হচ্ছে।”
[সুকুমারী ভট্টাচার্য, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, (দীপ প্রকাশন, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, ২০১৮) পৃ. ৪৫]
২০২৪ সালের সরকারী পাঠ্যপুস্তকেও হুবহু এই মতের প্রতিফলন ঘটেছে। দেখুন:
এর চেয়ে মিথ্যে আর কোনো কথা হতে পারে না। কীভাবে এরা এসব মিথ্যে কথা আমাদের বাচ্চাদের মনমগজে ভরে দিচ্ছে। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বিষয় হল, এ অংশে বাংলার যেসব মুসলমান শাসকের কথা বলা হচ্ছে, এরা আরব-পারস্য থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এরা সকলেই এই মাটিরই সন্তান। বাংলার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা। এদের শরীরে বাঙালির রক্ত। চলুন দেখি:
শাসক | পরিচয় | |
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৫২) | দিল্লির অধীনস্থ রাজ্য সোনারগাঁও-এর গভর্নর এর সৈনিক | ফখরউদ্দিন বর্তমান নোয়াখালী জেলার পূর্বাংশে অবস্থিত গ্রামের এক সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের সঠিক অবস্থান নিয়ে সন্দিহান থাকলেও ধারণা করা হয়, এটি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলায় অবস্থিত। [1] [1] Mashuq-e-Rasul, Dr Khalid, ed. (1992). নোয়াখালীর লোকসাহিত্যে জনজীবনের পরিচয় (in Bengali). Bangla Academy. |
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ [শাহ-ই-বাঙ্গালাহ] (১৩৪২-১৩৫৮) | দিল্লির অধীনস্থ রাজ্য লখনৌতির গভর্নরের কর্মচারী | Syed A M R Haque এর মতে, তাঁর পূর্বপুরুষরা এদেশে আসেন ইরানের সীস্তান থেকে। তিনি এই মাটিতেই জন্মেন। বিক্রমপুরের একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ বিধবাকে বিবাহ করেন। মুসলিম হয়ে নাম রাখেন ফুলমতি বেগম। পরবর্তী সুলতান সিকান্দার শাহ এঁর সন্তান। [1] [1] Durgachandra Sanyal, Dinesh Chandra Sen, Sen, Dinesh Chandra (1928), Br̥haṯ baṅga: Dbitīẏa khaṇḍa (in Bengali), Calcutta: University of Calcutta, p. 65 Nalini Kanta Bhattasali, Abdul Karim, Abdul Karim (1959). Social History of the Muslims in Bengal (Down to A.D. 1538). Asiatic Society of Pakistan. pp. 145–146. তিনি এই মাটিতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমাদের জামাইও বটে। অথচ দেখেন, কী বলা হল পাঠ্যবইয়ে। |
সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯৩) | ইলিয়াস শাহের ছেলে | মা বাঙালি ব্রাহ্মণ মেয়ে ফুলমতি বেগম। তিনি বিয়েও করেন এক হিন্দু নারীকে, যার গর্ভে জন্ম নেন পরের সুলতান। এরপরও নাকি এঁরা বিদেশী, বহিরাগত। [1] [1] Atul Sur, Bangla O Bangalir Bibortan,, Calcutta, pp.175-76. |
গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ (১৩৯৩-১৪০৯) | সিকান্দারের ছেলে | মা স্থানীয় বাঙালি হিন্দু। |
সাইফুদ্দিন হামযা শাহ (১৪০৯-১৪১১) | গিয়াসউদ্দিনের ছেলে | পরে জানাচ্ছি ইনশাআল্লাহ |
শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ | হামযা শাহের ক্রীতদাস | পরে জানাচ্ছি ইনশাআল্লাহ |
রাজা গণেশ (১৪১৪-১৪১৮) | দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার ও গিয়াসুদ্দিনের রাজস্ব ও শাসন বিভাগের কর্মকর্তা | |
যদু সেন ওরফে জালালুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪১৮-১৪৩২) | গণেশের ছেলে | বলুক এও বহিরাগত। |
শামসুদ্দিন আহমদ শাহ (১৪৩২-১৪৪২) | জালালুদ্দিনের ছেলে | এও বহিরাগত। আইরনি। |
নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯) | ইলিয়াস শাহের বংশধর | সেসময়ের ইতিহাসবিদ ফিরিশতার মতে, ইনি বাংলার গ্রামে একজন কৃষক হিসেবে জীবন কাটাচ্ছিলেন।.[1] [1] Sarkar, Jadunath, ed. (1973) [First published 1948]. "VI: Later Ilyās Shahis and the Abyssinian Regime". The History of Bengal. Vol. II: Muslim Period, 1200–1757. Patna: Academica Asiatica. |
রুকনুদ্দিন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) | পুত্র | |
শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ২য় (১৪৭৪-৮১) | পুত্র | মীরা নামের এক হিন্দু নর্তকীকে বিবাহ করে। ইসলাম গ্রহণ করে নাম রাখে লোটান বিবি।[1] [1] Sarkar, Jagadish Narayan (1985). Hindu-Muslim Relations in Bengal: Medieval Period. Idarah-i Adabiyat-i-Delli. p. 53 |
জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-৮৭) | পুত্র | |
হাবশি শাসন (১৪৮৭-৯৩) | ||
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) | শেষ হাবশি সুলতানের উজির | ড. নীতিশ সেনগুপ্তের মতে, তাঁর মা-ও বাঙালি মেয়ে।[1] Francis Buchanan-Hamilton সাহেবও আলাউদ্দিন হুসাইনকে রংপুরের দেবনগর গ্রামের নিবাসী বলে উল্লেখ করেছেন।তাই যদি হয়, তবে হুসাইন শাহ তো এই ভূমিরই সন্তান। অথচ দেখেন বইয়ে কী বলল: [1] "The Golden Age of Hussain Shah". Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib. Penguin Books India. 2011. p. 91 |
কেউ এদেশের জামাই, কেউ এদেশেরই আমাদের মেয়ের গর্ভজাত সন্তান, কেউ আমাদের ছেলেপুলের সাথেই এই মাটি-হাওয়ায় খেলেধুলে মানুষ, এদেশেরই মুসলিম কৃষকের বংশধর। শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রবল হিন্দুপ্রাণ পণ্ডিত পর্যন্ত বলেছেন,
“মুষ্টিমেয় তুর্কী বিজেতা ও তাহাদের পারসীক, পাঠান ও পাঞ্জাবী-মুসলমান অনুচর যাহারা বাঙ্গালায় রহিয়া গেল, তাহারা বাঙ্গালার হিন্দুর সাহায্যেই বাঙ্গালায় দিল্লী হইতে স্বাধীন এক মুসলমান-শাসিত রাজ্য স্থাপন করিল। তুর্কী ও অন্য বিদেশী বিজেতৃগণ দুই-চারি পুরুষের মধ্যেই বাঙ্গালী বনিয়া গেল। তখনও উর্দু ভাষার উদ্ভব হয় নাই।… বাঙ্গালায় উপনিবিষ্ট বিদেশী মুসলমানদের বাঙ্গালী স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইত; তাহাদের সন্তানেরা ভাষায় বাঙ্গালীই হইত।”
[সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, (মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৫২ বাং.) পৃ. ২৪]
দেখুন, বারো ভুঁইয়ার নেতা ঈশা খানকে কীভাবে বহিরাগত, জনসম্পৃক্ততাহীন বানিয়ে দিল ।
মুসলমান নাম মানেই বহিরাগত ধরে নিয়ে ইতিহাস লিখতে বসলে এসব ভুল হবেই। ঈশা খান ও মুসা খান বহিরাগত নন, বরং ঈশা খানের দাদা ছিলেন দেওয়ান ভাগীরথ, যিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের দেওয়ান, বাংলার সুলতানের নিযুক্ত। এরপর তাঁর ছেলে দেওয়ান কালিদাস সুলতানের পক্ষে দেওয়ান নিযুক্ত হন। এই কালিদাস মুসলিম হয়ে নাম রাখেন সুলাইমান খান। তাঁর ছেলে ঈশা খান। ঈশা খানের ছেলে মুসা খান। সেনাবাহিনী গঠন, একের পর এক ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ দখল, এগারসিন্দুর শহরের পত্তন, বিশাল রাজ্য শাসন— এতকিছু স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা, যোগদান, সমর্থন ছাড়া কীভাবে সম্ভব?
ভাবখানা যে, সাধারণ মানুষ আর্মিতে চাকরি করত না। হিন্দুরা সরকারি চাকরি-বাকরি করতো না। ক্ষমতা-কাঠামো জনজীবনে কোনো প্রভাবই ফেলতো না। এর চেয়ে অসত্য কোনো কথা হতে পারে না। অথচ সুলতানি আমলে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ছিল বাঙ্গালি কনভার্টেড মুসলিম ও হিন্দু। সুলতানী বাহিনীতে বিপুলসংখ্যক হিন্দু সেনা যুদ্ধ করেছে, নিহত হয়েছে। দিল্লীর বিরুদ্ধে পুরো বাংলা এক হয়ে লড়াই করেছে। ফিরোজ তুঘলক বাংলা হিন্দুদের প্রতি যে বার্তা লিখেছে, তাতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ সমর্থন তারা করত বাংলার সুলতানকে। উঠে এসেছে অনিরুদ্ধ রায়ের গবেষণাপত্রে:
এরকম হাজার হাজার ভুল তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিমসন্তানদেরকে ইসলামবিদ্বেষী করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সরকারি বইয়ে। বাচ্চারা মুসলিম পরিচয়কে ঘৃণা করতে শিখবে। হাজার হাজার বৃষ্টি খাতুন হয়ে যাবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। চোখের পানি ফেলা ছাড়া মাবাপের আর কিছুই করার থাকবে না।
অলরেডি এসব আমাদের বাচ্চারা দুই বছর পড়ে ফেলেছে। মশিউজ্জামান, বন্ধু সোশ্যাল, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল আর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি মিলে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই ভূখণ্ডে। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।